সমাজকল্যাণে অগ্রনায়ক মোস্তাক হোসেন গ্রন্থটি প্রকাশের পথে
ফারুক আহমেদ,অয়ন বাংলা-
উনিশশো সাতচল্লিশ সালের দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের অবস্থা ছিল একেবারেই করুণ ও সংকটাপন্ন। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কালের ধারাবাহিকতায় নানা পর্যায়ের কায়িক শ্রম ও ছোট পরিসরে ব্যবসা করে কেউ কেউ স্বল্পবিস্তর আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে শুরু করে। তবে কেউ কেউ আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে শুরু করলেও শিক্ষাদীক্ষায় তাদের অবস্থান ছিল একেবারে তলানিতে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটতে শুরু করে আশির দশকে। আর এই পরিবর্তনের নিমিত্তে মহীরুহ হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিল্পপতি মোস্তাক হোসেন। মহৎপ্রাণ এই মানুষটি উদার হস্তে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ দিয়ে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে মানবতার দূত হিসেবে এগিয়ে আসেন। দৃঢ় প্রত্যয়ে তাই বলতে হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মোস্তাক হোসেন-এর আর্থিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া মিশন স্কুলগুলো। তাঁর একক কৃতিত্ব ও সোনালি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বাঙালি মুসলিম সমাজ অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর পথে প্রবেশ করেছে। এমনকী তাঁর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার কারণে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবশ্রেণির মানুষ প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছেন। সে কারণে আজ বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের অনগ্রসর মুসলিম মানসে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারে বসন্ত এনে দিয়েছেন দানবীর মোস্তাক হোসেন। সমাজসেবী ও দানবীর মোস্তাক হোসেনকে তাই অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে মানবকল্যাণের অগ্রযাত্রায়। সংগত কারণে কৃতজ্ঞতার দায়বোধ থেকে নয়া সমাজ নির্মাণের অগ্রনায়ক মোস্তাক হোসেনকে কুর্নিশ জানিয়ে কলম ধরেছেন ৮৫ জন ঋদ্ধপ্রাবন্ধিক। উদার আকাশ পত্রিকা ও উদার আকাশ প্রকাশনের সম্পাদক ফারুক আহমেদ সম্পাদনা করছেন গ্রন্থটি। মূল্যবান প্রবন্ধ সংকলনটি ‘সমাজকল্যাণে অগ্রনায়ক মোস্তাক হোসেন’ উদার আকাশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। ঋদ্ধ প্রাবন্ধিকদের মধ্যে কলম ধরেছেন অশোক দাশগুপ্ত, ড. মইনুল হাসান, কবীর সুমন, আহমদ হাসান ইমরান, জয়ন্ত ঘোষাল, সাহানা নাগ চৌধুরী, হারাধন চৌধুরী, জয়ন্ত সিংহ, সুমন ভট্টাচার্য, দেবাশিস পাঠক, ড. মীর রেজাউল করিম, ড. রতন ভট্টাচার্য, মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. আমজাদ হোসেন, মৌসুমী বিশ্বাস, প্রবীর ঘোষ রায়, সুব্রতা ঘোষ রায়, ড. আবুল হাসনাত, ড. মুজিবর রহমান, গোলাম রাশিদ, তুষার ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ আবদুল হাই, আবদুর রউফ, আয়ুব আলি, সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ, ঘনশ্যাম চৌধুরী, জালাল উদ্দীন আহম্মেদ, আশিকুল আলম বিশ্বাস, আলিমুজ্জমান, সামসুল হুদা আনার, মাহমুদ কামাল, ড. সেখ আবু তাহের কমরুদ্দিন, সোনিয়া তাসনিম, সমীর ঘোষ, হাফিজ মাহবুব মুর্শিদ, ড. ঈশিতা সুর, আসাদুল্লা আল গালিব, কাজী খায়রুল আনাম, মুজতবা আল মামুন, বজলে মুর্শিদ, এমদাদুল হক নূর, ড. কুমারেশ চক্রবর্তী, আবদুল ওদুদ, কুতুব আহমেদ, সামিমা মল্লিক, ড. মুহম্মদ মতিউল্লাহ, শেখ সাদী মারজান, মোঃ হাসানুজ্জামান, প্রদীপ মজুমদার, ড. সুরঞ্জন মিদ্দে, সন্দীপ চক্রবর্তী, লালমিয়া মোল্লা, জহিউ-উল-ইসলাম, ড. সা’আদুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ আলি, ড. রমজান আলি, ড. মুহাম্মদ মসিহুর রহমান, মহম্মদ সামিম, ড. আফতাবুজ্জামান, জ্যোতির্ময় সরদার, ড. শেখ কামাল উদ্দীন, ড. কালাচাঁদ মাহালী, এম হৃদয় হোসেন, সামশুল আলম, ড. সাইদুর রহমান, ড.সৈয়দ নুরুস সালাম, ড. গৌতম নিয়োগী, আরফান আলি বিশ্বাস, ড. মিতালী সরকার, আসফার হোসেন, তৈমুর খান, ড. মহ: শামীম ফিরদৌস, মুজিবুর রহমান, ইমরান মাহফুজ, দীপক সাহা, সৈয়দ রেজাউল করিম, আকমাম খান, তপন মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ইবনে ইমাম, সাবির আহমেদ প্রমুখ। বইটির ভূমিকা লিখেছেন পবিত্র সরকার।
উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনের পক্ষ থেকে মোস্তাক হোসেন-এর হাতে ‘দানবীর পুরস্কার’ তুলে দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণে অফুরন্ত অবদানের জন্য মোস্তাক হোসেন পথিকৃৎ, তাঁকে সম্মাননা প্রদান করতে পেরে উদার আকাশ পত্রিকা ও উদার আকাশ প্রকাশন গর্বিত হয়েছে।
জিডি স্টাডি সার্কেলের মিশন স্কুল গড়ে উঠেছে মোস্তাক হোসেন-এর আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে। এই মিশন আন্দোলনে শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনের সোনালি পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই বাঙালি মুসলিম সমাজ এগিয়ে আসছে। তাঁর ছত্রছায়ায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলেই উপকৃত হয়েছেন এবং নিয়মিত হচ্ছেন। বর্তমানে মুসলিম দরদি সহমর্মী মোস্তাক হোসেনকে অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম উঠে আসুক সমাজকল্যাণে। অনুপ্রেরণা অবশ্যই মোস্তাক হোসেন। মামূন ন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বক্তা সম্রাট গোলাম আহমাদ মোর্তজা। জিডি স্টাডি সার্কেলের পরিচালনায় সমস্ত মিশন স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম মিশন স্কুল হচ্ছে মামূন ন্যাশনাল স্কুল। ইতিমধ্যে জিডি স্টাডি সার্কেলের উদ্যোগে সরকারি চাকরির উপযুক্ত করে তুলতে কোচিং দিয়ে বড় সাফল্য লাভ করেছে। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি দফতরে নতুন প্রজন্ম যোগ্যতা প্রমাণ করে চাকরি পাচ্ছেন। মোস্তাক হোসেন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন পিছিয়ে পড়া সমাজের একটা অংশ।
প্রাককথন
পথচলা শুরু বিশ শতকের চল্লিশ দশকে। পারিবারিক সচ্ছলতা ছিল, জমিজমা ছিল বিস্তর। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন বিশ্বাসই পরিবারের কৃষি পরম্পরা ভেঙে প্রথমবার পা দিলেন ব্যবসায়। ভারত-পাক বিভাজনের প্রক্রিয়া যখন শুরু তখন সংশয়ে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। গঙ্গা-পদ্মার ভাঙনে জর্জরিত মুর্শিদাবাদের মানুষ, কৃষি বিপন্ন হওয়ার কারণে ধুঁকতে থাকা নিরন্ন মানুষ তখন খুঁজে পেতে চাইছে বাঁচার জন্য সামান্য একটি কাজ। কারণ, তখন বন্ধ হয়ে গেছে জঙ্গিপুর কেন্দ্রিক নীল চাষ, লাক্ষা চাষ; হাতছাড়া তাঁদের কৃষিজমিও। এই বিপন্ন সময়ে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ ত্রাতা হিসেবে প্রথমে খুঁজে পান গিয়াসউদ্দিন বিশ্বাসকে। পতাকা ছায়ায় এসে দৈনিক মজুরিতেই মানুষ সংসার প্রতিপালনে এগিয়ে এলেন। ধুলিয়ান, অওরঙ্গাবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কারখানা। গিয়াসউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও আত্মপ্রত্যয়ী, দুঃসাহসী এবং ভীষণভাবে সংবেদনশীল। প্রায় পুঁজিহীন ব্যবসার সূত্রপাত করেন তিনি। তাঁর সততা, কর্মচারীর প্রতি বিশ্বাস ও সহৃদয়তা তাঁকে ধীরে ধীর উন্নয়নের পথে ধাবিত করে। সেই মুহূর্তে তাঁর শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৬০ থেকে ৬৫ হাজার। এর পরে তো ইতিহাস হয়ে সামনে এসে যায় পতাকা।
মোস্তাক হোসেন: পরম্পরা যাঁর হাতে অর্পিত হল
জন্ম ও বংশতালিকা
গিয়াসউদ্দিন বিশ্বাসের পাঁচ পুত্র ও চার কন্যা। মোস্তাক হোসেন পঞ্চম। তাঁর চার ভাইয়ের নাম যথাক্রমে দাউদ হোসেন, কালিমুদ্দিন হোসেন, আবুল কালাম ও এনামুল হক। চার বোন হলেন আমিনা বেগম, আবিদা বেগম, রাবিয়া বেগম ও মেরিনা বেগম। মোস্তাক হোসেনের জন্ম মুর্শিদাবাদের অওরঙ্গাবাদের চাঁদড়া নামক গ্রামে, ১৯৫৭ সালে। মোস্তাক হোসেনের পত্নীর নাম সানোয়ারা হোসেন। বাপের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৮৪ সালের মে মাসে। মোস্তাক হোসনের দাম্পত্যজীবনে এসেছে তাঁদের তিন সন্তান। দুই পুত্র শারিফ হোসেন ও সাহিল হোসেন এবং এক কন্যা মুশরেফা হোসেন। বাঙালির জীবন থেকে একান্নবর্তী পারিবারিক ভাবনা উঠে গেলেও মোস্তাক হোসেনের পরিবারে আজও সেই একান্নবর্তী ভাবনা বর্তমান বাংলার পারিবারিক সংকটের মুখে এক অনন্য উদাহরণ।
শিক্ষা
মোস্তাক হোসেনের প্রথম পাঠ শুরু হয়, তাঁর চাঁদড়া গ্রামের প্রদীপ পাঠশালাতেই। তারপর ভর্তি হন নিমতিতার গৌরসুন্দর দ্বারকানাথ ইনস্টিটিউটে। স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন বহরমপুরের ঐতিহ্য সম্বলিত রাজা কৃষ্ণনাথ কলেজে। এখান থেকেই তিনি অ্যাকাউন্টেন্সিতে বি.কম. পাশ করেন। চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি নিয়ে পড়তে গিয়েও পিতার অসুস্থতার কারণে পড়াশুনায় তাঁর বিরতি ঘটে। অকপটে তিনি স্বীকার করেছেন, ৭৯ বছর পর ১৯৭৮ সালে পরম্পরাগত অশিক্ষায় অন্ধকারে সফল আঘাত পড়ল অর্থাৎ আমিই বংশের প্রথম গ্র্যাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম। পরের বছরই মুখ উজ্জ্বল করল, বি.এ. পাশ করে আমার ভাইঝি রোশনারা। আমার আগে কেউই কলেজের গণ্ডি পেরোতে পারেনি।
মোস্তাক হোসেনের কর্মযোগ
১৯৮০ সালে পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি সাময়িক পড়াশুনা ছেড়ে ব্যবসার দেখভাল করতে থাকেন। ব্যবসাতে ঢুকে পড়ে তিনি আর পড়াশুনার জন্য ফিরে যেতে পারেননি। পিতার পায়ের ছাপ অনুসরণ করেই পাড়ি দেন এক অজানা পথে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বুঝে যান পতাকার খুঁটিনাটি পরিস্থিতি। তখন তাঁদের ব্যবসার বাজার ছিল সীমাবদ্ধ রাজ্যের কয়েকটি জেলা ও অসম প্রদেশে। আসু ও আবসু আন্দোলনে অসম উত্তাল হওয়ার কারণে অসম বাজারও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে চিন্তা করেই মোস্তাক হোসেন অন্যত্রও ব্যবসা বাড়াতে শুরু করেন।
পতাকা দৌড়। পতাকার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যেই তিনি প্রথমে পা রাখেন দিল্লিতে। দিল্লি তাঁকে নিরাশ করেনি। পতাকা উড়তে থাকে সমানে। এরপরে তিনি পা রাখেন হরিয়ানায়। লালা সুশীল শেঠ-এর সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় হরিয়ানার দখল পায় এই পতাকা। দিল্লি, হরিয়ানার পর তিনি একে একে রাজস্থান, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, দক্ষিণ ভারতে পতাকাভিযান চালিয়ে ভীষণভাবে সাফল্য লাভ করেন। শিল্পকে পৌঁছে দেন শীর্ষচূড়ায়। এই ব্যবসাকে তিনি শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছেন নিজস্ব ক্ষমতাবলে এবং ঐকান্তিক নিষ্ঠায়। তাঁর এই বিজয় সাফল্যের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। একাধারে তিনি ঝুঁকিপ্রবণ, ঝুঁকি নিয়েই বিভিন্ন প্রান্তে ব্যবসাকে প্রসারিত করতে উদ্যোগী হন। ভীষণ নিষ্ঠার সঙ্গে সততার সঙ্গে সংবেদনশীলতার সঙ্গে গণসংযোগ স্থাপন করেন। তিনি তাঁর শিল্পের জন্য পাতার চাষ ও উৎপাদনের বৃদ্ধিতে প্রয়াস নেন, আত্মনিয়োগ করেন। আর সর্বোপরি তিনি শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, যাতে উন্নতমানের শিল্পজাত উৎপাদন সম্ভব হয়। দক্ষতা ছাড়াই সকলেই কাজের উপযুক্ত হতে পারেন—কিন্তু কাজটা যাতে যথাযথভাবে শিখে নিতে পারেন তার জন্য তিনি ২৫ জনের একটি প্রশিক্ষকের দল গঠন করেন। শ্রমিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তাঁদের ব্যবহার করা হত। এ-কারণেই ৮০-র দশকে যে ব্যবসায় তাঁর শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৬০ থেকে ৬৫ হাজার, এক দশকের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় দু’লাখে। এভাবেই তিনি পতাকা শিল্পকে ৯০ দশকে নিয়ে আসেন ১০-এর মধ্যে, ৯৪-এ তিন-এ এবং তিন বছরের মধ্যে এক নম্বরে। এখন পতাকা শিল্পে এক লাখ ষাট হাজারের বেশি শ্রমিক পিএফ ব্যবস্থা আওতায় রয়েছেন। প্রতিদিন প্রায় দশ কোটি এক-একটা শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়। এই ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন দু’লক্ষের বেশি মানুষ।
কিন্তু ৫০২ পতাকা শিল্পকে শীর্ষে পৌঁছে দিয়েই তিনি ক্লান্ত নন। ব্যবসার সমৃদ্ধি ঘটিয়ে তিনি একে একে জুড়ে দেন রেশম শিল্প থেকে ফুডপার্ক। অবশেষে তিনি একান্তভাবে মনোনিবেশ করেন সার্বিক শিক্ষার প্রসারে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, পতাকা গোষ্ঠীর ফুড প্রসেসিংও বিশ্বের শিল্প বাজারে বিশেষ ভূমিকা নেবে। চা-শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, রেশম শিল্প থেকে ফুডপার্ক—তারাও পরে বাজার দখল নেবে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় এবং বিস্কুট শিল্পেও ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে। ৪২ বিঘা জমির উপর দশটি বাগানময় রেশমের সুতো তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন মালদায়। নবাব আমলে রেশম শিল্প মুর্শিদাবাদ মালদা সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এই ভাবনা মাথায় রেখে তিনি রেশম ব্যবসায় ঢুকে পড়েন ১৯৯৪-এ। তিনি জানতেন বাংলাদেশের রাজশাহী আজ রেশমশিল্পে বিশ্ববাজার পেয়েছে। মুর্শিদাবাদ-মালদায় তা হতে পারে। তিনি জানতেন বাংলায় যথেষ্ট রেশমের চাষ হলেও চাষিরা তার মুনাফা পায় না। এর লাভ পায় বাইরের দালালরা। তাই রেশমশিল্পের চাষিদের কথা মাথায় রেখেই তিনি এই ব্যবসায় হাত লাগান। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিদেশি যন্ত্রপাতি নিয়েই দেশি মানুষদের নিয়েই তাঁর এই রেশমের শিল্প সাফল্যের পর মোস্তাক হোসেন বিশেষ ঝুঁকি নিয়েই চা-শিল্পের ব্যবসায় নামেন। টাটা বিড়লা এবং হিন্দুস্থান লিভারের মতো বহুজাতিক প্রতিযোগী সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি চা-শিল্পের সংকটের কথা অবহিত হওয়ার পরেও তিনি এই ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও তিনি যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছেন। পতাকা চা আজ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও অন্যান্য প্রদেশে ঢুকে বাজার করে নিয়েছে। চা-শিল্পের বাজারেও পতাকা টি আজ সকলের পছন্দের ব্র্যান্ড।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সংলগ্ন উমরপুরে একশো একর জমির উপর শুরু হয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। মুর্শিদাবাদ, মালদায় প্রচুর পরিমাণ সবজি ও ফল উৎপন্ন হয়। শিলান্যাস করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর। এখানে শিল্প ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যেমন ফল ও সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যাবে তেমনই ফলের প্রক্রিয়াকরণ করে তা আন্তর্জাতিক বাজারেও পাঠানো যাবে। মোস্তাক হোসেনের ভাবনায় ছিল, চাষিদের উৎপাদনে যেন তাঁরা ন্যায্যমূল্য পেতে পারেন তার উপর। খাদ্য প্রকল্পের পাশাপাশি থাকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাদ্য শিল্প। বহুজাতিক সংস্থার ও পতাকার যৌথ উদ্যোগে এখানে মোস্তাক হোসনের নবতম সংযোজন জি ডি হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াবেটিস ইনস্টিটিউট। মধ্য কলকাতার ওয়েলিংটন মোড়ে গড়ে তুলেছেন এই হাসপাতাল। আধুনিক যুগের স্বাস্থ্য পরিষেবা, উন্নততম প্রযুক্তি এবং বিখ্যাত চিকিৎসকদের দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এর কাঠামো। খুব সামান্য খরচে গ্রামের সাধারণ মানুষও এখানে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। দয়ালু মোস্তাক হোসেন দরিদ্র মানুষের বিনা খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে দেন। যা অতুলনীয়।
সমাজকল্যাণে মোস্তাক হোসেন
তিনি একজন শিল্পপতি। কিন্তু আজ একথাও কারও জানতে বাকি নেই যে তিনি একজন সমাজসেবী। সমাজকল্যাণের কাজ এভাবে কোনও শিল্পপতিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। তিনি একজন জনদরদি মানুষ। তিনি যতই বিত্তশালী হোন না কেন, তিনি কখনওই বিলাসী নন। অহমিকা তাঁকে কখনও গ্রাস করতে পারেনি। তাঁর মতো দয়ালু ব্যক্তিত্ব ইদানীং চোখে পড়ে না। তিনি সারা বাংলা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জিডি স্কলারশিপ প্রদান করেন। এই স্কলারশিপের টাকার পরিমাণ বছরে প্রায় কয়েক কোটি। অওরঙ্গাবাদের জি ডি চ্যারিটেবল সোসাইটিতে অসংখ্য দুঃস্থ রোগীর বিনা ব্যয়ে চিকিৎসা করা হয় এবং ঔষধ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর তিনি ব্যয় করেন কয়েক কোটি টাকা। প্রত্যেক বছর মুর্শিদাবাদ এবং মালদায় দরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনের জন্য মুক্ত হস্তে দান করেন।
মোস্তাক হোসেন এবং পতাকা শিল্পগোষ্ঠী পশ্চিম বাংলার দরিদ্র মানুষের স্বজন। এর প্রমাণ তিনি বহুবার দিয়েছেন, পশ্চিমবাংলার মানুষ বিপদের সম্মুখীন হলেই তিনি তাঁদের প্রতি সদয় হন। হাত বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার। ১৯৯৩ সাল টর্নেডোর প্রকোপে পড়ে তছনছ হয়ে গেছিল গোকর্ণ, চাটরা, খোশবাসপুর গ্রাম (মুর্শিদাবাদ)। সে সময়ে তিনি বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এই গ্রামগুলিতে তিনি একাই শতাধিক পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করে আনন্দবাজার লিখেছিল : সরকারের থেকে, রাজনৈতিক দলগুলির থেকেও অনেক বেশি করেছেন জেলার সাধারণ মানুষ এবং অন্যান্য জেলার মানুষ। টর্নেডোর পর সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত গ্রামাঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও মদত দিয়েছে। এই কথা গ্রামের বিভিন্ন মানুষের। তাঁরা গিয়াসউদ্দিন (মোস্তাক হোসেনের পিতা) নামে জনৈক ব্যবসায়ীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অওরঙ্গাবাদের এই ব্যক্তি গোকর্ণ, চাটরা, খোশবাসপুরে ১০০টি ঘর বানিয়ে দিয়েছেন নিজের খরচায়। ইটের দেওয়াল, টিনের ছাউনি। সেখানে স্থান পেয়েছেন গ্রামের মহিলারা। আনন্দবাজার, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪।
১৯৯৮ সালে ও ২০০১ সালে বন্যার প্রকোপ পড়ে মুর্শিদাবাদ এবং মালদার সাধারণ বানভাসি মানুষ ভীষণ অসহায়তার সম্মুখীন হয়েছিল। এই দুই জেলার বানভাসি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মোস্তাক হোসেন। ১৯৯৮ সালে তিনি দু’কোটি এবং ২০০১ সালে এক কোটি ২৭ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। প্রায় দু’লক্ষাধিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ এবং ত্রাণ সামগ্রী দান করেছেন। কার্গিল যুদ্ধে নিহতদের পরিবারের সহায়তার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাতে ১৯৯৯ সালের ১১ জুলাই তিনি ১১ লক্ষ টাকার চেক তুলে দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালের আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবন এলাকার নিপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মোস্তাক হোসেন। তিনি দু’কোটির অধিক ত্রাণ দিয়েছেন ওই এলাকায়। স্বভাবতই তিনি একজন কেবল শিল্পপতিই নন, তিনি একজন সমাজদরদি, সমাজকল্যাণে দায়বদ্ধ দয়ালু এক পরম ব্যক্তিত্ব। আজ একথা অনস্বীকার্য, তিনি কেবল হতদরিদ্র মানুষের বন্ধু নন, তিনি সরকারেরও বন্ধু। কারণ, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সমাজকল্যাণমূলক কাজে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেল ট্যাক্স থেকে সরকারের আয় হয়, যাতে পতাকা গোষ্ঠী প্রত্যেক বছর সরকারকে দিয়ে থাকে কোটি টাকা।
শিক্ষার প্রসারে মোস্তাক হোসেন
শিক্ষার প্রসারে মোস্তাক হোসেনের অবদান অনস্বীকার্য। আজ একথা সকলেরই জানা, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় একাধিক মিশন শিক্ষার জগতে আলোর জোয়ার আনতে সক্ষম হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, মিশন কেন্দ্রিক পড়াশুনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মোস্তাক হোসেন। তাঁরই উদ্যোগে মিশনের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজে শিক্ষার সার্বিক প্রসার ঘটেছে। জি ডি চ্যারিটেবল সোসাইটির তত্ত্বাবধানে আজ ৬০টির বেশি মিশন পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার প্রসারে ব্রতী হয়েছে। তিনি এই মিশনগুলিতে বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন গৃহনির্মাণ প্রকল্পে এবং ছাত্রছাত্রীদের অনুদান প্রকল্পে। এই মিশনগুলি ছাড়াও তিনি অন্য বহু বেসরকারি স্কুল ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ অনুদান দিয়ে থাকেন। মাদ্রাসা, মক্তবেও তাঁর অনুদান অনস্বীকার্য। শিক্ষার জগতে এই প্রসারের কারণে আজ বহু মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী জায়েন্ট এন্ট্রান্সের মাধ্যমে ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। গরিব দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচও তিনি বহন করেন। মেধাবী গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি স্টাইপেন্ড প্রদান করেন। শিক্ষার জগতে তাঁর এই বহুমুখী আন্দোলন জোয়ার এনে দিয়েছে—যার মাধ্যমে এবং অবশ্যই মোস্তাক হোসেনের সাহচর্যে ও অর্থানুকূল্যে অনুন্নত গ্রাম বাংলার গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে দ্রুত ধাবমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জেলা ও রাজ্যের বহু পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
মোস্তাক হোসেনের সাহিত্য
ভাবনা
৫০২ পতাকা শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার হয়েও, ভারতের একজন অন্যতম শিল্পপতি হয়েও বহুধা কর্মধারায় ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি একজন লেখক হিসেবে পরিচিত। তাঁর স্বচ্ছ ভাবনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর তিনটি গ্রন্থে: ১. নিশান ও নিশানা, ২. গুহার ভেতর আলো, ৩. আলোর নীচে আঁধার। গ্রন্থগুলিতে তাঁর সমাজ ভাবনার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
সমাজের জন্য জাতির জন্য তিনি যা করেছেন তা অপ্রতুল নয়, একথা মেনে নিয়েই তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন: ‘যে আমার প্রতিবেশী, যে আমার গ্রামের বাসিন্দা, যে আমার দূর সম্পর্কের ভাই কিংবা ভাইপো, যে আমার সম্প্রদায়, সমাজ ও জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, যে পাশে না থাকলে স্তিমিত হয়ে পড়ত পতাকা গোষ্ঠীর পতাকা, তারাই আমার এবং আমাদের ক্রমশ অচেনা ও দূরের বাসিন্দা হয়ে উঠছে। কাছাকাছি থাকি, তাদের দেহের ঘাম আমাদের সমৃদ্ধ করে, কিন্তু আমরা টের পাই না, তাদের ক্ষত ভরা অস্তিত্ব। স্পর্শ করি না পরিশ্রমী শ্রমিকের, আমারই অন্যতম সহোদর অগ্রজ কিংবা অনুজের দুঃখময় দুনিয়া। তারা এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারে প্রবেশ করে। তাদের খিদেয় তৈরি হয় নতুন খিদে। তাদের অনিদ্রা ও যন্ত্রণায় বাড়তে থাকে স্থায়ী অসুখ। আমরা দিব্যি চোখ বন্ধ করে, মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তাদের দুঃসহ বেঁচে থাকা, তাদের অজ্ঞানতা তাদের কুসংস্কার ও বিপদমগ্ন অচেতন অথবা স্তব্ধ হৃদয়কে কখনও উপলব্ধি করি না। এই ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছি। এর পেছনে পতাকা গোষ্ঠীর যদি কোনও ব্যর্থতা থাকে, তাহলে এর প্রধান সংগঠক হিসেবে এ আমারই ব্যর্থতা। ব্যথার আড়ালে যদি কোনও সামাজিক অক্ষমতা থাকে, এরও দায়ভার একান্তভাবে এই মোস্তাক হোসেনের।’ এই অকপট স্বীকৃতিই তাঁকে আরও মহান করেছে। তিনি একজন শিক্ষাদরদি মানুষ। তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় তাঁর ‘আলোর নীচে আঁধার’ গ্রন্থে। শিক্ষায় জাতির মেরুদণ্ড এই উপলব্ধি তাঁর অন্তরাত্মায়। তাই এই গ্রন্থে তাঁকে বলতে শুনি : …. ইহলৌকিক শান্তি ও কল্যাণের জন্য বিদ্যাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। যে বিদ্যা শুধু ব্যক্তিকে নয়, স্পর্শ করবে তার বংশকে, তার প্রতিবেশীকে, তার এলাকাকে, তার সম্প্রদায়কে, জাতিকে এবং সমগ্র মানব সমাজকে। শিক্ষা প্রসঙ্গে একজন শিল্পপতির এমনতর বক্তব্য নজিরবিহীন।
Director of Pataka Group Sarif Hossain said ‘‘The Chairman of Pataka Group, Mustak Hossain is a man of the nation, a visionary, a tycoon, a true leader and a person simplistic in every manner even after being in the 1000 Richest Indians of the World.
A visionary who in the early 1980s foresaw that national development can only arise from social welfare and focussed on community development business and philanthropy, shirking from all limelight.Today business schools and management theory terms it as ‘circular economy’. Leaders focus on action and have visions far ahead of their time.
A decade later the idea received economic Nobel prize and academic acknowledgment in the late 90s by a close friend an confidant.’’
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক উদার আকাশ, কলকাতা, ভারত।