রবীন্দ্রনাথের সন্তানাদি নিয়ে কিছু কথা :
সব্যসাচী সরকার :- মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ তিন মেয়ে ও দুই ছেলে সহ মোট পাঁচ সন্তানের জনক ও জননী ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরা ক্রমানুসারেঃ
বড় মেয়ে মাধুরীলতা দেবী (বেলা), বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রথী), মেঝ মেয়ে রেনুকা দেবী (রানী), ছোট মেয়ে মীরা দেবী (অতসী) ও ছোট ছেলে সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সমী)।
মাধুরীলতা দেবী (বেলা)
১৮৮৬ সালের ২৫শে অক্টোবর রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান মাধুরীলতার জন্ম হয়। কবিগুরু তাঁকে ‘বেলা’ বলেই ডাকতেন আদর করে কখনওবা ‘বেলী’ ও বলতেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় বিশেষত পত্র সাহিত্যে ‘বেলী’ নামের উল্ল্যেখ দেখা যায়।
মাধুরীলতা মাত্র পনের বছর বয়সে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সাথে ১৯০১ সালের জুলাই মাসের কোন একদিন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী পেশায় একজন আইনজ্ঞ ছিলেন।
মাধুরীলতা দেবী নিঃসন্তান ছিলেন এবং ৩১ বছর ৬ মাস বয়সে ১৬ মে ১৯১৮ সালে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর শ্বশুরালয়ে মৃত্যু বরন করেন।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রথী) :
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম গ্রহন করেন ১৮৮৮ সালের ২৭ নভেম্বর। ২১ বছর ২ মাস বয়সে ১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রতিমা দেবীকে বিয়ে করেন। বিবাহকালে প্রতিমা দেবীর বয়স ছিল সতের বছর। প্রতিমা দেবী ১৮৯৩ সালে জন্মগ্রহন করেন।
প্রতিমা দেবী কিন্তু নীলনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিধবা ছিলেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে প্রতিমা দেবীর এই বিয়ে বিধবা প্রথার বিরুদ্ধে ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ। যদিও রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রথী) ও প্রতিমা দেবী আলাদা হয়ে যান। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন কিন্তু একটি কন্যা সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন তাঁকে নন্দিনী বলেই ডাকতেন।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪ মে ১৯৫১ থেকে ২২ আগস্ট ১৯৫৩ পর্যন্ত বিশ্ব ভারতী বিস্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৩ জুন ১৯৬১ সালে ৭২ বছর ৬ মাস বয়সে দেরাদুনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে প্রায় ৭৬ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে প্রতিমা দেবী মৃত্যুবরণ করেন।
রেনুকা দেবী (রানী) :
রেনুকা দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় সন্তান এবং দ্বিতীয় কন্যা। জন্মগ্রহন করেন ২৩ জানুয়ারি ১৮৯১ সালে। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘রানী’।
রাণীর জন্মপোলক্ষে লিখেন ‘রাজা ও রাণী’। রাণীর বয়স যখন মাত্র দশ বছর, বড়দিদি মাধুরীলতার বিয়ের দেড় মাসের মধ্যেই তারও বিয়ে হয়ে যায়। কবি তাঁর এই কন্যাটিকে এত কম বয়সে বিয়ে দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেননা। কিন্তু মৃনালিনী দেবীর হিসেব ছিল অন্যরকম, সেদিনের সেই গ্রাম্য বালিকা জগৎ-সংসারের নিত্যদিনের হিসেব-নিকেশে খুব পাকা হয়ে উঠেছেন, সংসারের আবর্তে থেকে ততদিনে তিনি বুঝেছেন, এই জগৎ-সংসার সম্পর্কে তাঁর যেটুকু ধারণা, তাঁর স্বামীর ততটুকু ধারণা নেই। তাঁর স্বামী আত্মভোলা, সংসার উদাসী মানুষ, সদা ব্যস্ত থাকেন কবিতা, গান, নাটক রচনায়, সংসারের হাল-হকিকত নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পান না। এদিকে সঠিক তদারকির অভাবে জমিদারী আয়ও তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে, ভাল পাত্রের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, সেটা হাতছাড়া করা হবে চরম বোকামী। তাই সংসার কর্ত্রীর ইচ্ছেতে ১৯০১ সালের আগস্ট মাসের কোন এক দিনে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্যের সাথে রেনুকার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরে অবশ্য রেনুকাকে তার বাবার বাড়ীতেই রেখে দেয়া হয়েছিল, কথা ছিল সংসার করবার মত উপযুক্ত বয়স হলেই স্বামী বাড়ীতে পাঠানো হবে। কিন্ত স্বামী-সংসার শুরু করার পূর্বেই রেনুকা ক্ষয়রোগে( যক্ষ্মা) আক্রান্ত হয়ে ১৯০৩ সালের সেপ্টেমবার মাসের মাঝামাঝি সময়ে মারা যায়। প্রিয়কন্যা ‘রাণীর’ মৃত্যুতে কবি প্রচন্ড মানসিক আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন।
মীরা দেবী (অতসী):
মীরা দেবী রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা। ১৮৯৪ সালের ১২ জানুয়ারী জন্মগ্রহন করেন। তাঁকে অতসী নামেও ডাকা হত। কবি রচনা করেন গীতিনৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। ছোট কন্যাটির বিয়ে হয় ১৯০৭ সালের ৬ই জুন, নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে। মীরাদেবীর দুই সন্তান নীতিন্দ্রনাথ(নিতু)এবং নন্দিতা (বুড়ি)। পুত্র নিতু উচ্চশিক্ষার্থে যখন জার্মানীতে ছিলেন, সেখানেই ছাত্রাবস্থায় ১৯৩২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। নিতুও মারা যায় ক্ষয়রোগে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৭১ বছর। একমাত্র নাতির মৃত্যুশোকও উনাকে সইতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি নন্দিতা’র বিয়ে হয় সাংবাদিক ও লেখক কৃষ্ণ কৃপালিনী মহাশয়ের সাথে। কৃষ্ণ কৃপালিনী মহাশয় তাঁর ‘দাদাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ বায়োগ্রাফী লিখেছিলেন, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে। কৃপালিনী দম্পতীও নিঃসন্তান ছিলেন এবং এই নাতনীটিও দির্ঘজীবি হননি, মাত্র ৫১ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে উনি মারা যান। কন্যা নন্দিতার মৃত্যুর দুই বছর পর, ১৯৬৯ সালে শান্তিনিকেতনের শীতল ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ বংশধর মীরাদেবী, যাঁকে তাঁর পিতা অতসী নামে ডাকতেন, ৭৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সমী):
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম এবং সর্বশেষ সন্তানের জন্ম হয় ১৮৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বার। পুত্রের নাম রেখেছিলেন শমীন্দ্রনাথ, ডাকতেন ‘শমি’ বলে। কনিষ্ঠ পুত্রটিকে কবি ভীষণ ভালোবাসতেন। শমি’র জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে কবি রচনা করেন ‘সোনার তরী’। ততদিনে শান্তিনিকেতন নিয়ে কবির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা চলছে, রথি’র সাথে সাথে শিশু শমি’কেও ব্রহ্মচর্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। গেরুয়া বসন পড়ে ছোট শমি’কে দেখে কবি পরম আনন্দ লাভ করতেন। শমি’কে লাগতো সেই প্রাচীন মুনি ঋষিদের অনুগত শিষ্যের মত।
ছোড়দিদি মীরা’র বিয়ের সময় শমি অনেক আনন্দ ফূর্তি করেছে। ছোড়দি’র বিয়ের কয়েক মাস পরে শমি বাবার অনুমতি নিয়ে বন্ধুর সাথে কিছুদিন সময় কাটাবে বলে ‘মুঙ্গের’ বেড়াতে যায়। কবি আনন্দের সাথেই অনুমতি দিয়েছেন, কারণ কবি তাঁর বাল্যবয়সেই পিতার হাত ধরে ভারতের দর্শনীয় স্থান ভ্রমন করেছিলেন। মুঙ্গের পৌঁছে বন্ধুর সাথে শমির দিনগুলো আনন্দেই কাটছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই সে কলেরায় আক্রান্ত হয় এবং ১৯০৭ সালের ২৩শে নভেম্বার, মাত্র ১১ বছর বয়সে শমি মারা যায়। এবং দিনটি ছিল কবি পত্নীর পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকী, পাঁচ বছর আগে একই দিনে মৃনালিনী দেবী মারা গেছিলেন।
১৯০২ থেকে ১৯০৭, এই পাঁচটি বছর কবির জন্য ছিল চরম ভয়াবহ, শুধুই হারাণো, মানুষ অল্পশোকে হয় কাতর, অধিক শোকে হয় পাথর। আমাদের এই কবি পাঁচ বছরে যা কিছু হারিয়েছেন, তাতে বেদনায় পাথরও মনে হয় গলে গিয়েছিল!
১৯০২ সালে উনার স্ত্রী বিয়োগ ঘটে।
১৯০৩ সালে প্রিয় কন্যা রাণী মারা যায়
১৯০৫ সালে উনার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয়
১৯০৭ সালে উনার কনিষ্ঠ সন্তান, অতি প্রাণপ্রিয় শমীন্দ্র মারা যায়।
তথ্যসূত্র :
Rabindranath Tagore : A Centenary Volume 1861 – 1961 Published by Sahitya Akademi
On the Edges of Time by Rathindranath Tagore
পোস্ট ঋণঃ সাব্যসাচী সরকার আসানসোল ভারত https://www.facebook.com/sabyasachi.sarkar.737