মুর্শিদাবাদের  ভূমিপুত্র প্রখ্যাত  সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্মদিনে কিছু কথা 

Spread the love

মুর্শিদাবাদের  ভূমিপুত্র প্রখ্যাত  সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্মদিনে কিছু কথা

 

নিউজ ডেস্ক:-    প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (1930-2012) মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে 1930 খ্রীস্টাব্দের 14ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পলাতক কিশোরের জীবন অতিবাহিত করেছেন। রাঢ় বাংলার লোকনাট্য “আলকাপের” সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে অংশ নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন৷ তিনি ছিলেন ‘আলকাপ’ দলের “ওস্তাদ” (গুরু)। নাচ-গানের প্রশিক্ষক। নিজে আলকাপের আসরে বসে হ্যাজাগের (পেট্রোম্যাক্স) আলোয় দর্শকের সামনে বাঁশের বাঁশি বাজাতেন। নিজের দল নিয়ে ঘুরেছেন সারা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, এমনকি বিহার-ঝাড়খন্ডেও। তাই পরবর্তী জীবনে কলকাতায় বাস করলেও নিজেকে কলকাতায় প্রবাসী ভাবতেই ভালোবাসতেন। সুযোগ পেলেই বার বার মুর্শিদাবাদের গ্রামে পালিয়ে যেতেন। সেই পলাতক কিশোর তার চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। ঘুরতেন সেই রাখাল বালকের মাঠে, হিজলের বিলে, ঘাসবন ও উলুখড়ের জঙ্গলে, পাখির ঠোঁটে খড়কুটো আর হট্টিটির নীলাভ ডিম -সেই মায়াময় আদিম স্যাঁতসেতে জগতে।

তাঁর পিতার সঙ্গে বর্ধমানের কর্ড লাইনে নবগ্রাম রেল স্টেশনের কাছে কিছুদিন ছিলেন। সেখানে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। সেই নবগ্রাম গোপালপুরের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছিলেন ‘প্রেমের প্রথম পাঠ’ উপন্যাস। তার লেখকজীবনের প্রথম দিকের উপন্যাস। গোপালপুর থেকে পাশ করে তিনি ভর্তি হন বহরমপুর কলেজে।

তাঁর “ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু”, “ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন”, “তরঙ্গিনীর চোখ”, “জল সাপ ভালোবাসা”, “হিজলবিলের রাখালেরা”, “নৃশংস”, “রণভূমি”, “মাটি”, “উড়োপাখির ছায়া”, “রক্তের প্রত্যাশা”, “মানুষের জন্ম”, “মৃত্যুর ঘোড়া”, “গোঘ্ন”, “রানীরঘাটের বৃত্তান্ত”, ইত্যাদি অসংখ্য ছোটগল্পের জন্য বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে একঝাঁক লেখক বাংলা সাহিত্যে উদিত হন, যেমন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যশোদাজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়, রতন ভট্টাচার্য, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী — এঁদেরই সঙ্গে আবির্ভাব ঘটে সিরাজের । তবে তার অভিজ্ঞতা ছিল বিপুল, তার বিচরণ ক্ষেত্র ছিল দ্বারকা নদীর অববাহিকায় আদিম প্রবৃত্তিতে ভরা নারীপুরুষ ও উন্মুক্ত প্রকৃতি। এই এলাকার নাম ‘ হিজল’ যা কান্দী মহকুমার অন্তর্গত। তার ‘হিজলকন্যা” উপন্যাসে সেই অঞ্চলের নরনারীকে ধরা আছে । মুস্তাফা সিরাজ কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে৷ দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে চাকরি ও লেখালেখি সমানতালে চালিয়ে গেছেন৷ তাঁর জ্ঞান ও অধীত বিদ্যাসমূহ ও প্রগতিশীল মুক্তচিন্তা তাঁকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ ইতিহাস,সমাজতত্ত্ব , নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব — সব বিষয়েই তাঁর জ্ঞান ও বিদ্যার গভীরতা তাঁকে পণ্ডিতমহলে পরিচিত করে তুলেছে।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখক সত্তায় জড়িয়ে ছিল রাঢ়ের রুক্ষ মাটি। মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূম। যেখানে লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। একই জলহাওয়া তাঁদের দুজনকেই প্রাণোন্মাদনা দিয়েছিল। তাই তারাশঙ্কর বলতেন, “আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে।”

তাঁর “ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু”, “ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন”(দেশ-এ প্রকাশিত প্রথম গল্প), “তরঙ্গিনীর চোখ”,”জল সাপ ভালোবাসা”, “হিজলবিলের রাখালেরা”, “রণভূমি”, “উড়োপাখির ছায়া”, “রক্তের প্রত্যাশা”, “মৃত্যুর ঘোড়া”, “গোঘ্ন”, “রানীরঘাটের বৃত্তান্ত”, ইত্যাদি অসংখ্য ছোটগল্প অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে । তার প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস – “নীলঘরের নটী”। পর পর প্রকাশিত হয় “পিঞ্জর সোহাগিনী”, “কিংবদন্তির নায়ক”,”হিজলকন্যা”,”আশমানতারা”, “উত্তর জাহ্নবী”, “তৃণভূমি”, “প্রেমের প্রথম পাঠ”, “বন্যা”,”নিশিমৃগয়া”,”কামনার সুখদুঃখ”, “নিশিলতা”, “এক বোন পারুল”, “কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি”, “নৃশংস”,”রোডসাহেব”, “জানগুরু” ইত্যাদি ইত্যাদি৷ তার গল্প ও একাধিক গ্রন্থ ভারতের সমস্ত স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এমনকি ইংরেজি তো বটেই, বিশ্বের বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে৷

তাঁর লেখা ‘তৃণভূমি” উপন্যাসে কান্দি মহকুমার এক বৃহৎ অঞ্চল ধরা আছে। “উত্তর জাহ্নবী” উপন্যাসে ধরা আছে এক বিশেষ সময় ও সমাজের কথা, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত। আর “অলীক মানুষ” এক বিস্তৃত ভুবনের কাহিনী, যা এক মুসলিম পির বা ধর্মগুরুর বংশে জাত পুরুষের আত্মানুসন্ধান। ব্রিটিশের রাজত্বের শেষভাগে এক পরিবর্তনীয় সময়ের নিখুঁত স্থির ছবি। এই অলীক মানুষ তাকে ভিন্ন লেখকের মর্যাদার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করেছে।

ক্ষুদে ও কিশোর পাঠকদের দাবি মেটাতে তিনি সৃষ্টি করলেন “গোয়েন্দা কর্নেল” নামে একটি চরিত্র। এনার পুরো নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। যাঁর মাথা জোড়া টাক, ঠোঁটে চুরুট, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, এখন প্রজাপতি ও পাখি দেখতে ভালোবাসেন। নিজেকে প্রকৃতিপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দিতে ভালবাসেন অথচ তিনি অনেক অপরাধ ও হত্যার কিনারা করে শখের গোয়েন্দাগিরি করেন৷ গোয়েন্দা কর্নেল পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সিরাজ প্রাপ্তবয়স্ক দের জন্যেও কর্নেল কাহিনী লিখেছেন। ‘কর্নেল সমগ্র’ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকের ধারণা, কর্নেলের যে চেহারা ও অবয়ব চিত্রিত হয়েছে তা নাকি ফাদার দ্যতিয়েনের সঙ্গে মিলে যায়। সিরাজ আরো একটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেন পরিনতমনস্ক পাঠকদের জন্যে। তিনি ছিলেন ‘ইনস্পেকটর ব্রহ্ম’।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ছিল প্রবল। সংবাদপত্রে চাকরি করলেও কোনও মালিকানাগোষ্ঠীর কাছে মাথা নিচু করেন নি । ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাস ছাপা হয় ধারাবাহিকভাবে ‘চতুরঙ্গ’ নামে একটি লিট্‌ল ম্যাগাজিনে। “তৃণভূমি” ছাপা হয় অধুনালুপ্ত ‘ধ্বনি’ নামক এক ছোট পত্রিকায়। বড় পত্রিকায় চাকরি করলেও তার সেরা উপন্যাসগুলি ছাপা হয়েছে ছোট পত্রিকায়। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের প্রতি ছিল তার সস্নেহ পক্ষপাত। মিডিয়ার আলো ও প্রচারের প্রতি তার আকুলতা ছিল না। নিজের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রায় একা উন্নত গ্রীবায় ছোট ফ্ল্যাটে জীবনকে কাটিয়ে গেছেন। মাথা উঁচু করে থাকার দর্পী মনোভাবের জন্য তাকে অনেক মনোকষ্ট পেতে হলেও তিনি দমে যান নি। পাঠকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর। তাঁর ব্যবহারে ও আচরণে ছিল পরিশীলিত ভদ্রতা ও আন্তরিকতা

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার – এসব ছাড়াও ভুয়ালকা পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত। তার ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’ বইয়ের জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার। এছাড়া ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার । পেয়েছেন বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার, সুশীলা দেবী বিড়লা স্মৃতি পুরস্কার, দিল্লির OUF সংস্থার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুরস্কার, শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি আরও অনেক পুরস্কার তিনি তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য-কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন। তার অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, যেমন ‘কামনার সুখ দুঃখ’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘শঙ্খবিষ”। দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় ‘নিশিমৃগয়া’। উত্তমকুমার অভিনীত ‘আনন্দমেলা’। অঞ্জন দাশ পরিচালনা করেছেন সিরাজের ছোটগল্প ‘রানীরঘাটের বৃত্তান্ত’ অবলম্বনে ফালতু। সিরাজের “মানুষ ভূত” কাহিনী চলচ্চিত্র ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে ক্রমাগত অভিনীত হয়ে চলেছে। এই স্কুল পালানো মানুষটিই পেয়েছিলেন সাম্মানিক ডক্টরেট উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
আজ জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক ও বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য ।

**    ঝিঙে ফুল পত্রিকা থেকে নেওয়া হয়েছে**

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.