সুন্দরবন অঞ্চলের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বাঁচাতে ‘সুন্দরবন সৃজন উৎসব’-২০২১
পরিমল* *কর্মকার ,সন্দেশখালি : শেষ হল ৪ দিনের সুন্দরবন সৃজন উৎসব। মেলা বা উৎসব মানে শুধুই নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়, খাওয়া-দাওয়া নয়, এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কিছু দাবি আদায়েরও মঞ্চ হচ্ছে মেলা বা উৎসব। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিমাদ্রি মিশন-এর উদ্যোগে সন্দেশখালি থানার দুর্গামণ্ডপ হিমাদ্রি মিশন প্রাঙ্গণে এবার ৩টি দাবিকে সামনে রেখে ১৫ তম ‘সুন্দরবন সৃজন উৎসব’-২০২১ অনুষ্ঠিত হয়। প্রদীপ প্রজ্বলন করে উৎসবের শুভ সূচনা করেন সন্দেশখালির বিধায়ক সুকুমার মাহাতো। উৎসবের মঞ্চ থেকে বিধায়কের হাতে হিমাদ্রি মিশন-এর পক্ষ থেকে তিনটি দাবি সম্বলিত দাবিপত্রটি বিধায়কের হাতে তুলে দেন মিশনের সভাপতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সঞ্জিত জোতদার।
হিমাদ্রি মিশনের ৩টি দাবি হল-
১) সুন্দরবন অঞ্চলের ১৯টি ব্লকের মধ্যে জয়নগর-২, হাড়োয়া এবং সন্দেশখালি-২ এই তিনটি ব্লকে কোনও ডিগ্রি কলেজ নেই। আমরা চাই, সন্দেশখালি-২ ব্লকে একটি ডিগ্রী কলেজ হোক। কারণ, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর সন্দেশখালি-২ ব্লকের ছাত্র- ছাত্রীদের বি.এ, বি.কম,বা বি.এস.সি পড়তে গেলে কালিনগর কলেজ, মিনাখাঁর বামনপুকুর কলেজ, গোসাবার পাঠানখালী কলেজে বা কলকাতার কোনও কলেজে যেতে হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলেজে ক্লাস করে রাতে বাড়ি ফেরে। অনেকে আবার শহরে গিয়ে থেকে লেখাপড়া করতে বাধ্য হয়। তাই আমাদের দাবি, “সন্দেশখালি-২ নম্বর ব্লকে কলেজ চাই, পান্তা খেয়ে পড়তে চাই।” সন্দেশখালি যেহেতু আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা তাই এই কলেজের নামকরণ করা হোক বীর বিরসা মুণ্ডার নামে “সন্দেশখালি বিরসা মুণ্ডা কলেজ।”
২) হিমাদ্রি মিশন ২ মার্চ ২০১৫ সন্দেশখালি-২ ব্লকের দুর্গামণ্ডপ ও সুখদোয়ানীর মাঝে মজে যাওয়া বালি নদীর চরে ‘দুর্গামণ্ডপ আম্বেদকর ক্রীড়াঙ্গন’ তৈরি করে। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ দুর্গামণ্ডপ আম্বেদকর ক্রিড়াঙ্গনটির উদ্বোধনের দিন এলাকার কয়েকজন যুবক হিমাদ্রি মিশনকে ভুল বুঝে ক্রীড়াঙ্গনটি দখল করে নেয়। উদ্বোধন করতে এসে মাঝ রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরে যান সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা। এরপর ওই যুবকেরা ক্রীড়াঙ্গনটিকে ফিশারিতে পরিণত করে। দু’বছর পর এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওই ফিশারির সব মাছ ধরে নেয় এবং ফিশারির বাঁধ কেটে দেয়। অবিলম্বে দুর্গামণ্ডপ আম্বেদকর ক্রীড়াঙ্গনটি হিমাদ্রি মিশনকে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) সন্দেশখালি-২ ব্লকের দুর্গামণ্ডপ পুরাতন বাজার (শরৎ সেতু) থেকে দুর্গামণ্ডপ সরদার পাড়া হাইস্কুলের সেতু (রাধু সরদার সেতু) পর্যন্ত তিন কিলোমিটার ৩০০ফুট ইটের রাস্তাটি পিচ ঢালাই করতে হবে।
বিধায়ক সুকুমার মাহাত বলেন, “অন্য মেলায় গেলে হয়তো প্রচুর ভিড় দেখতে পেতাম। ড্যান্স হাঙ্গামা হলে এখানে জায়গা দেওয়া যেত না। কিন্তু সুন্দরবন সৃজন উৎসবের উদ্যোক্তারা সেদিকে না গিয়ে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এখানে মেলায় ভিড় কম হলেও সৃজনমূলক কিছু হচ্ছে। আন্তরিকতার সঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাই আমি চাই, সুন্দরবন সৃজন উৎসবকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটুক। এলাকার উন্নয়নমূলক বিভিন্ন দাবিতে এই উৎসবের মঞ্চ থেকে উঠুক। হিমাদ্রি মিশনকে আমরা সব রকম সাহায্য করব।”
হিমাদ্রি মিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. সঞ্জিত জোতদার বলেন, “সুন্দরবন সৃজন উৎসবে শুধুই বিনোদন নয়, এই উৎসবের মাধ্যমে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিবির, মানুষকে সচেতন করা, এলাকার উন্নয়ন, সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন এবং সুন্দরবন অঞ্চলের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে এই সুন্দরবন সৃজন উৎসব।”
এবার সৃজন উৎসবে ছিল টুসু, ঝুমুর, বাউল, তরজা, নৃত্য, বসে আঁকো ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, কৃষিজাত পণ্যের স্টল, ড. দানী কর্মকার রচিত ও নির্দেশিত রবীন্দ্রনগর নাট্যায়ুধ-এর সাড়া জাগানো নাটক ‘অন্তরণ’। কানমারী ‘সবুজ মেরুণ স্বপ্ন’ দলের ঝুমুর নৃত্য দর্শকদের মন কাড়ে। মনোজ্ঞ সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুপ্রভাত মণ্ডল, গৌরি বিশ্বাস, পল্লবী বিশ্বাস, জয়িতা রায় প্রমুখ। নকুল চন্দ্র সরকারের স্মৃতিতে তরজা গান পরিবেশন করে সুন্দরবন জাগরণ তরজা দল।
“হিমাদ্রি মিশন অ্যাওয়ার্ড” প্রদান অনুষ্ঠানে ‘হাজারীলাল মণ্ডল স্মৃতি পুরস্কার’ পেলেন শিক্ষানুরাগী অমল নায়েক। ‘মুরারিমোহন মণ্ডল স্মৃতি পুরস্কার’ পেলেন ডাক্তার পুলিনবিহারী পাল। ‘রাধাকান্ত মণ্ডল স্মৃতি পুরস্কার’ পেলেন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ এবাদাৎ হোসেন। ‘ভূপেন্দ্রনাথ মণ্ডল স্মৃতি পুরস্কার’ পেলেন সপ্তর্ষি বৈদ্য।
এছাড়াও উৎসবে উপস্থিত ছিলেল শিক্ষানুরাগী অমল নায়েক, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ড.দানী কর্মকার, নাট্যব্যক্তিত্ব বর্ণালী কর্মকার, নাট্যব্যক্তিত্ব রজত কুমার মণ্ডল, চিত্রশিল্পী বিশ্বরূপ দে, চিত্রশিল্পী সুনীল চক্রবর্তী, ডা: গিরীন্দ্র নাথ মণ্ডল, ডা: কিরণময় ঘোষ, অধ্যাপক ড. দেবজ্যোতি মণ্ডল, অধ্যাপক সুশান্ত মজুমদার, সমাজকর্মী রণজিৎ কুমার মণ্ডল, ছত্রধর বিশ্বাস, অভিজিৎ আচার্য ভাদুড়ী, সাংবাদিক ভক্তরাম সর্দার, চন্দনা মাহাতো, শ্রীদাম হাউলি, দেবরাজ মাহাতো, হরিশংকর কুন্ডু, প্রসেনজিৎ রায়, প্রবীর রঞ্জন মণ্ডল, সুন্দরবন সৃজন উৎসব কমিটির সম্পাদক সাংবাদিক হিমাদ্রি শেখর মণ্ডল প্রমুখ।