তেলেনিপাড়ার ঘটনার গ্রাউন্ড রির্পোট দ্যা ওয়ার এর সাংবাদিক হিমাদ্রী ঘোষ এর কলমে

Spread the love

তেলেনিপাড়াঃ দাঙ্গার প্রকৃত তথ্য উন্মোচন

The Wire (দ্যা ওয়ার ) এর সাংবাদিক হিমাদ্রী ঘোষ ১৫ ই মে তেলেনিপাড়া দাঙ্গার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর তার বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে তার সংক্ষিপ্তসার তুলে দেয়া হলো।

ওয়েব ডেস্ক:- যখন সারা বিশ্ব লড়াই করছে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের বিরুদ্ধে তখন হুগলী নদীর ধারে অবস্থিত তেলানিপাড়া লড়াই করছে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। কলকাতা থেকে ৪০ কিমি উত্তরে এক কালে পাট শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ তেলেনিপাড়া ভদ্রেশ্বর টাউনের একটা ছোট এলাকা, ১২ ই মে থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ১০ ই মে সন্ধ্যায় তেলানিপাড়াতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হালকা বচসা হয় যা পুলিশের হস্তক্ষেপে সমাধা হয়ে যায়। ১১ ই মে কোনো উত্তেজনা দেখা যায়নি। কিন্তু তার পর দিন দুপুর নাগাদ বিশাল জনতা একত্রিত হয় এবং স্থানীয়দের কথা অনুযায়ী হুগলী নদীর অপর পর থেকে আসা বহিরাগতদের দ্বারা বিরাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। পরের দিন থেকে জেলা শাসক ওই এলাকায় এবং আশপাশের চন্দননগর ও শ্রীরামপুর মহকুমায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করেন।

১৫ ই মে The Wire এর সাংবাদিক জিটি রোড ধরে কলকাতা থেকে তেলেনিপাড়া যাওয়ার পথে ভদ্রেশ্বরের বাবুর বাজারে একটা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত দোকান দেখতে পান যার ওপরে “সাদ” নাম তখনও বোঝা যাচ্ছিল। আবার ভদ্রেশ্বর দমকল কার্যালয়ের উল্টো দিকে একটা মাজার দেখা যায় যেটা গেরুয়া গুন্ডাদের দ্বারা ভাঙচুর করা হয়েছে। এলাকাটা তখন প্রচন্ড শান্ত ছিল কিন্তু মানুষের মুখে মুখে তেলানিপাড়া দাঙ্গার কথা শোনা যাচ্ছিল।

তেলানিপাড়ার আগে দিনেমারডাঙ্গা স্ট্রিটের কাছে স্পেশালাইজড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ানের প্রায় ৩০ জন জওয়ান মোতায়েন ছিল। জিটি রোড থেকে পুরো দিনেমারডাঙ্গা পর্যন্ত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার রাস্তার আশপাশে কোনো জ্বলে যাওয়া কোনো বাড়ি বা দোকান চোখে পড়েনি। তেলেনিপাড়ার কাছাকাছি দুটো আগুনে জ্বলে যাওয়া গাড়ি চোখে পড়ে যার একটার নম্বর প্লেট উধাও ছিল আর অপরটির নম্বর দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেলো মালিকের নাম গুলাম আনসারী। এলাকার মানুষের কাছে গত ১২ তারিখের ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তারা কিছু জানিনা বলে এড়িয়ে গেল।

দিনেমারডাঙ্গা থেকে গন্দলপাড়া মিলের দিকে যাওয়ার পথে দেখা গেলো দাঙ্গার প্রকৃত ভয়াবহ রূপ। বাড়িগুলো প্রায় সব আগুনে ভস্মীভূত, রাস্তার আসে পাশে গলে যাওয়া টিভি সেট, ছিন্ন কেবিল তার, পুড়ে যাওয়া গৃহস্থালির আসবাব পত্র ইত্যাদি চোখে পড়লো, অনেক বাড়ীর ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে তার ভিতরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে। রাস্তার ওপরে শুধু ইট, পাথর, লোহার রড ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। তখনও কিছু কিছু বাড়ি থেকে ধোঁয়া উদ্গীরিত হচ্ছিল দেখা যাচ্ছিল অসংখ্য বোতল যা থেকে কেরোসিনের গন্ধ প্রকট ছিল।

হতবাক করার মত বিষয় হলো যে এক জায়গায় তিনটি মুসলিম মালিকানার জেরক্সের, মুদিখানা ও মাংসের দোকান ভস্মীভূত হয়েছিল কিন্তু ঠিক তার পাশের দুটো হিন্দু মালিকের মুদিখানা ও দর্জির দোকান সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ছিল। সামনে রাস্তার ওপর সাইকেল, মোটরবাইক, টেম্পো ইত্যাদি গাড়িগুলো আগুনে জ্বলে পরিত্যাক্ত হয়ে গিয়েছে।

একটা ওম লেখা বাড়ির একদিক পুড়ে গিয়েছে দেখা যাচ্ছিল কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ওপর দিকটা অক্ষত আছে। এক স্থানীয় ব্যক্তির থেকে জানা যায় ওই বাড়ির সামনে এক মুসলিম বাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে এই বাড়িটার একটা অংশ জ্বলে যায়। সেখানে পরিদর্শনরত এক পুলিশ অফিসারকে, কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে এই দাঙ্গা ঘটানো হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ওই দোকানটার দিকে দেখুন ওটার কিছু হয়নি এবার ওর ওপরে নামটি পড়ুন। এটা একটা পূর্বপরকল্পিত ঘটনা যার সামনের ভাগে ছিল বহিরাগতরা কিন্তু এলাকার অনেকে তাদের সঙ্গে ছিল নাহলে এতো বড়ো দাঙ্গা সঠিক ভাবে নির্দিষ্ট বাড়ি, দোকান ও গাড়িকে চিহ্নিত করে আঘাত করা সম্ভব হতো না।তিনি আরো বলেন ১২ তারিখের পর থেকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে।

৫৩ বছরের স্থানীয় কেবিল অপারেটর মোহাম্মদ মুস্তাক নিজে চোখে দেখেছে, মুখে কালো কাপড় জড়ানো বোমা হাতে জয় শ্রী রাম স্লোগান দিয়ে আসা বহিরাগত দাঙ্গাবাজদের হাতে তার জেরক্সের দোকান ও বাড়ি লুট হতে এবং পুড়ে ছাই হয়ে যেতে। তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, “আমি তাদেরকে হাত জোড় করে অনুরোধ করলাম আমার একমাত্র সম্বল দোকানটার কোনো ক্ষতি না করতে কিন্তু তারা শুনলনা, এখন আমাদের আর কিছু নেই শুধু মাত্র আমরা যা পরিধান করে আছি এটা ছাড়া।”

মুস্তাকের ৮৩ বছর বয়সের বাবা রাস্তার এক ধারে বসেছিলেন, আমাদের দেখে আমাদের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন কিছুু বলতে পারলেন না।

মুস্তাকের স্ত্রী শবনম বলেন, “এই দোকানের পাশে আমাদের আরো দুটো দোকান আছে যা হিন্দুদের কাছে ভাড়ায় দেয়া আছে, দেখুন ওগুলোর কিছুই হয়নি, এর থেকে বড়ো প্রমাণ কি দরকার যে শুধুমাত্র মুসলিমদেরকেই নিশানা করে আক্রমণ করা হয়েছে?”

স্থানীয়দের অভিযোগ পুলিশ অনেক দেরিতে ঘটনাস্থলে আসে। মুহাম্মদ আনসারি, যার বাড়ি আংশিকভাবে পেট্রোল বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বললেন, আমরা দেখি ১২ ই মে সাড়ে ১২ টা থেকে ১ তার মধ্যে গণ্ডলপাড়া এলাকার দিক থেকে দুষ্কৃতীরা পেট্রোল বোমা নিয়ে মুসলিম বাড়িগুলোর ওপর চড়াও হয়, তখন আমরা ১০০ নাম্বারে ডায়াল করি তারপর ভদ্রেশ্বর থানায় ফোন করে পরিস্থিতিতে সম্পর্কে অবগত করি। আমার ভাই দমকল বিভাগকে ফোন করে কিন্তু সবাই অনেক দেরিতে আসে। প্রথমে মাত্র ১০ জন পুলিশ আসে প্রায় আড়াইটার দিকে কিন্তু তা খুবই অপর্যাপ্ত ছিল এবং তাদের দিকে দুর্বৃত্তরা বোমা এবং পাথর ছুড়তে থাকে। উপযুক্ত সংখ্যক পুলিশ আসে বিকাল ৪ টার সময় কিন্তু তখন সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল।

অবসরপ্রাপ্ত পাট কর্মী শামসুদ্দিন জানান এই ঘটনার সূত্রপাত হয় রবিবার সন্ধ্যায়। অন্য সূত্র থেকে জানা যায় যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একজনের করোনা ধরা পড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন এক মুসলিমকে পাবলিক শৌচাগার ব্যবহার করতে দেয়নি যা থেকে ধীরে ধীরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। শামসুদ্দিন বলেন, ঘটনার দিন আমি তাদেরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু তারা আমাকে সজোরে চড় মারে এবং স্থানীয় হিন্দু গোয়ালা দাঙ্গাবাজদের প্রতিরোধ করার সাধ্যমতো চেষ্টা করেন নাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত।

গণ্ডলপরা থেকে ফেরি ঘাটে দিকে যাওয়ার পথে সামনে পড়া কালভার্টের নিচে ড্রেনে অনেক পরিত্যাক্ত গ্যাস সিলিন্ডার ও মোটরবাইক দেখা গেলো। সেখানে মোতায়ন স্পেশালাইজড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ানের একজন জওয়ানের কাছে থেকে জানা গেলো যে ওই এলাকায় ১১ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কর্তব্যরত ছিল যে ওই এলাকায় নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ করে হামলা করা হয়েছিল এবং হামলাকারীরা প্রচুর পরিমান পেট্রোল বোমা ব্যাবহার করেছিল এবং অ্যাসিড ও হয়তো ব্যাবহার করেছিল। তিনি আরো বলেন, ” আমরা সংখ্যায় অনেক কম,আর আমাদের হাতে শুধু লাঠি আর আমাদের সামনে ৬০০ জনের বেশি সশস্ত্র জনতা হলে আমরা কি করতে পারি?”

তেলানীপাড়া এলাকাটা তিনদিক থেকে স্থলভাগে ঘেরা এবং একদিকে হুগলী নদী যার ওপর পেটের জগদ্দল, বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহের সংসদীয় ক্ষেত্র ব্যারাকপুরের অংশ। স্থানীয় প্রৌঢ় মুহাম্মদ সেলিমের মতে অর্জুন সিংহের লোকজন নদী পার হয়ে এসে দাঙ্গা করে চলে গিয়েছে। এমনকি নদীর কাছাকাছি মুহাম্মদ নিহাল নামের এক পুলিশ সাব ইনস্পেক্টরের বাড়িও আক্রমণ করা হয়েছে যিনি এখন স্বপরিবারে উত্তর ২৪ পরগনায় কর্তব্যরত আছে।
৫০ বছরের জুলফিকার আলী বলেন, “আমার বাবাকেও তারা আঘাত করে এবং আমার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আমার একমাত্র আয়ের উৎস গরুটা নিয়ে চলে গিয়েছে।” তিনি আরো বলেন, “আমার পাশের বাড়িটি স্থানীয় কাউন্সিলর চিত্রা চৌধুরীর যিনি গত ২৫ বছর কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হয়ে আসছেন কিন্তু তিনি ঘটনার সময় কোনো হস্তক্ষেপ করেননি”। তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন যে সঙ্গে তার ২৫ বছরের ছেলে ছিল সেই সময় তাই তিনি বোমাধারি দুষ্টকৃতিদের মাঝে যেতে সাহস পাননি। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বলেন তিনি আক্রান্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি কারণ তার কিছু করার নেই।

স্থানীয় কোনো তৃণমূলের নেতা নেত্রী ওই এলাকায় এখনও পরিদর্শনে যায়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ যে তাদের সংসদ সদস্য ইন্দ্রনীল সেন কখনো ওখানে আসেন না নির্বাচনের সময় ছাড়া। The Wire এর তরফ থেকে মি. সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

চন্দননগর পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির বলেন, “এটা পূর্ব পরিকল্পিত ঘটনা এবং আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৯১ জনকে গ্রেফতার করে কোর্টের সামনে পেশ করেছি এবং পরের দিন ৩৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে”।

ওই এলাকার বিজেপি রাজ্যসভার সাংসদ লকেট চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। বিজেপির বাংলায় কেন্দ্রীয় পরিদর্শক কৈলাশ বিজয় বর্গীয় একটা ভিডিও টুইট করেন যাতে দেখা যাচ্ছে লকেট চ্যাটার্জী বলছেন এটা একপাক্ষিক যুদ্ধ, হিন্দুদেরকে শুধু নিশানা করা হচ্ছে, তিনি অনেক ফোন কল পাচ্ছেন নির্যাতিত হিন্দুদের কাছে থেকে কিন্তু রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এছাড়াও পাকিস্তানের একটি ভিডিও তেলানিপাড়ার হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ভিডিও বলে চালানো হচ্ছে টুইটারে। পশ্চিম বঙ্গের সর্বাধিক প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকার নামে ভুয়া খবরের পেজে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা উসকানিমূলক খবর ছড়ানো হয়েছে। এটি দাঙ্গার অন্যতম কারণ

The Wire ঘটনাস্থলে প্রায় তিন ঘণ্টা অতিবাহিত করে। বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি মুসলিমদেরই হয়েছে এবং রাজা বাজার এলাকায় কয়েকটি হিন্দু বাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ রূপে এটা পূর্বপরিল্পিত এবং সুচারুরুপে সংঘটিত একটি দাঙ্গা। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যদি তারা সময় মতো ব্যাবস্থা নিত অনেক ক্ষতি এড়ানো যেত। আক্রান্তদের আপাতত সাহায্য করার মতো কেউ নেই। রাজ্য সরকারের কোনো প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি বা ক্ষতি পূরণ করতে কোন আশ্বাস দেননি।

তথ্য সূত্র : The Wire ( ভাষান্তর করেছেন সাইফুল্লা লস্কর।) সমস্ত ছবি তুলেছেন হিমাদ্রী ঘোষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.