বঙ্গভিটা।
দেশভাগের বলি হয়েছিলেন ভারতের বীরভূমে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের গুণী এই বিজ্ঞানী…..
ওয়েব ডেস্ক :- সময়কাল ১৯০০ সালের ১০ মে।ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মাড়গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মালেন হজরত সৈয়দ শাহ সুফী খোন্দাকার আব্দুল মুকিদ এবং সৈয়দা ফাসিয়া খাতুনের সন্তান মুহম্মদ কুদরত এ খুদা।
পৈতৃক নিবাস মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান সীমানাবর্তী মৌগ্রাম।
বাবা আব্দুল মুকিদ সে যুগের ইংরেজি শিক্ষিত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির স্নাতক। সে যুগে ইংরেজি জানা মানুষের পক্ষে ইংরেজ সরকারের অফিসে চাকরি খুব সহজেই পাওয়া যেত । কিন্তু খোন্দাকার আব্দুল মুকিদ ধর্মকর্ম নিয়ে থাকতেই পছন্দ করতেন। কলকাতার তালতলায় এক পীরের তিনি শিষ্য ছিলেন। স্থানীয় মানুষ তাঁকেও পীর হিসেবে মান্যতা দিতেন।
পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় গ্রাম মাড়গ্রাম। ১৮৮১ সালে এই গ্রামে একটি অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল এম.ই. স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলেই কুদরত এ খুদার লেখাপড়া শুরু। এর পরে কলকাতায় এসে ১৯১৮ সালে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি পরীক্ষায় প্রথম হলেন।
ভারতীয় মুসলিম সমাজে তিনিই প্রথম ডি.এস.সি – গোটা দেশের নিরিখে অষ্টম ডি.এস.সি। লন্ডন থেকে তিনি ‘সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি’তেও ডক্টরেট হলেন। এ কাজ খুব সহজে হয়নি। রাষ্ট্রীয় বৃত্তি পাওয়া নিয়েও সমস্যা হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দরখাস্ত করতে বললেও তা অজ্ঞাতকারণে নামঞ্জুর হয়। তখন স্যর আবদার রহিমের হস্তক্ষেপে ‘রাষ্ট্রীয় বৃত্তি’ পেলে তিনি গবেষণার জন্য বিলেত যান।
১৯৩১ সালে কুদরত সাহেব প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হলেন। ’৩৬-এ রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক। ১৯৪২-’৪৪ সালে ইসলামিয়া কলেজ, বর্তমানের মৌলানা আজাদ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারতের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ডঃ কুদরাত-এ-খুদা নিজ দেশের ভূমি ছেড়ে পরিবার নিয়ে কলকাতা ত্যাগ করে বাংলাদেশে চলে আসেন।
পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (পিসিএসআইআর) পূর্বাঞ্চলীয় শাখার পরিচালক-সংগঠক হিসেবে ড. মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বনজ, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম সঠিক ব্যবহারের জন্য গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করেন। বনৌষধি ও গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, কাঠকয়লা এবং মৃত্তিকা, লবণ ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। স্থানীয় বিভিন্ন গাছগাছড়া থেকে জৈব রাসায়নিক উপাদান নিষ্কাশনে সক্ষম হন, যা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আনারস ও কলার ছোবড়া থেকে অত্যন্ত সুন্দর রেশমী ঔজ্জ্বল্যবিশিষ্ট লম্বা আঁইশ বের করতে সক্ষম হন। কবিরাজ ও হেকিমদের ব্যবহৃত নাটাকরহ থেকে তিনটি রাসায়নিক উপাদান, তেলাকুচা থেকে বারোটি যৌগ ছাড়াও তিনি তুলসী, বিষ কাঁটালী, গুলঞ্চ, কালমেঘ, হরিদ্রা, কচুরীপানা, ক্যাসাভা ইত্যাদি থেকে বিভিন্ন জৈব পদার্থ নিষ্কাশন করেছিলেন যার সবই ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পাটখড়ি থেকে কাগজ তৈরি তাঁরই গবেষণার ফল। পাটকাঠি থেকে পারটেক্স উৎপাদন, চিটাগুড় ও তালের গুড় থেকে ভিনেগার প্রস্তুত ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। বিজ্ঞানী হিসেবে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা ও তাঁর সহকর্মীদের ১৮টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারেরর পেটেন্ট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সঞ্চিত খনিজ দ্রব্যের ওপর তথ্য নিয়ে কোথায় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তার ইঙ্গিত লিপিবদ্ধ করে তিনি বাংলা একাডেমী থেকে একটি বই প্রকাশ করেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হন ড. কুদরাত-এ-খুদা। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে তিনি অল্প সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবেদনে তিনি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর একটি সার্বিক আলোচনা এবং এর ভবিষ্যত রূপরেখা সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এক কর্মধারা উপস্থাপন করেন। এই প্রতিবেদনটি “কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট” নামে পরিচিত যা তাঁর কর্মজীবনের একটি বিশেষভাবে স্মরণীয় অবদান। ১৯৭৫ সালে ড. কুদরত-এ-খুদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
★ লেখক : অরনিবাস গুপ্ত