“অধীর চৌধুরী”র না বলা কথা ,আবেগ ঘন স্মৃতির পটে “সোমেন মিত্র”

Spread the love

অধীর চৌধুরী
(লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতা, বহরমপুরের সাংসদ, প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী)

ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার শ্রদ্ধেয় নেতা সোমেন মিত্র আমাদের মধ্যে আর জীবিত নেই। গত কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। খোঁজ খবর রাখছিলাম। ভেবেছিলাম সুস্থ হয়ে উঠবেন। কারণ, সোমেন মিত্র বরাবরই লড়াকু। এর আগে দিল্লির এইমসে তাঁর চিকিৎসা হয়েছে। তখনও দ্রুত রোগ কাটিয়ে উঠেছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু এ বারটি আর হল না।

সোমেনদার মৃত্যু আমাকে দুঃখে কাতর করেছে। মর্মাহত করেছে। কেন না সোমেনদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো শুধু রাজনৈতিক ছিল না। একটা আবেগের সম্পর্ক ছিল। সোমেন দা ছিলেন আমার অভিভাবক। পলিটিক্যাল মেন্টর। আমি কংগ্রেস রাজনীতিতে পা দিয়েছিলাম তাঁরই হাত ধরে। তিনিই আমাকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাই আমি কখনও বিধায়ক হয়েছি, কখনও সাংসদ হয়েছি।

আমার পরিষ্কার মনে পড়ে সে সব দিনের কথা। বামেদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। সেই লড়াইয়ে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছি। সে জন্য কংগ্রেসের নেতাদের কাছে সাহায্য চাইছি। কিন্তু কংগ্রেসের কেউই সে ভাবে আমাকে চিনতেন না। গুরুত্বও দিচ্ছিলেন না। আমাদের ওখানকার এক নেতার হাত ধরে প্রথমে গিয়েছিলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। কিন্তু তাঁর কাছে যে আশা নিয়ে গিয়েছিলাম তা পূরণ হল না। আমি বলব না ওঁরা আমার সঙ্গে অন্যায় করেছিলেন। বরং বলা যায় হতাশ করেছিলেন।

কিন্তু আমি তখন মরিয়া। একেবারেই ডেসপারেট! কিছু করতেই হবে। বামেদের এই অত্যাচার আর সহ্য করব না। তাই সোমেন মিত্রের কাছেও গেলাম। সোমেনদা খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন। হয়তো তখনই রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারেননি। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই কাঁধে হাত রেখেছিলেন। আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

৯১ সালে বিধানসভা ভোটে আমি মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থেকে ভোটে লড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। নবগ্রাম তখন সিপিএমের ভিয়েতনাম। ভোটের দিন ওরা আমাকে প্রায় মেরেই দিচ্ছিল। কোনওরকমে জীবন বাঁচাতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওরা ফেউয়ের মতো পিছনে লেগে রইল। সিপিএমের এক কর্মী খুনের অভিযোগ তুলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করল। বাংলা ছেড়ে আমাকে পালাতে হল।

কংগ্রেসের জন্য আমি যখন এভাবে লড়াই করছি, দেখছি দলের অনেকেই আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। তখন ফের সোমেন মিত্রের কাছে গিয়ে বললাম, দাদা আমি তো কংগ্রেসের হয়েই লড়াই করছি। আমার কি কোনও অন্যায় হয়েছে? ওদিকে বামফ্রন্টের পুলিশ আমাকে গুলি করে মেরে দেওয়ার কথা বলছে। আর এদিকে কংগ্রেসের দলে কেউ তাকাচ্ছে না, ডেকে কথা বলছে না, আমার কথা শুনছে না! যেন আমি অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছি।

সেদিন সোমেনদা বলেছিলেন, অধীর চিন্তা করো না। আমি তোমার পাশে থাকব। সোমেনদার সেই কথাটা আমাকে নতুন করে রাজনীতি করার প্রেরণা যুগিয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের জন্য উৎসাহিত করেছিল। সেদিন থেকে বুঝতে পারি, রাজনীতিতে আমার একজন অভিভাবক রয়েছে। এও বুঝতে পারি, সোমেন মিত্র শুধু কংগ্রেসের নেতা নন, বড় মনের মানুষ। কেউ সমস্যায় পড়লে ডান-বাম না ভেবে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর বড় হৃদয় রয়েছে তাঁর। আর সে যদি কংগ্রেসের কর্মী হয়, তা হলে তো কথাই নেই।

এর পর থেকে সোমেনদাই আমাকে বার বার রাজনীতিতে পথ দেখিয়েছেন। আমার মতো একজন পলিটিক্যাল অরফ্যান তথা রাজনৈতিক ভাবে অনাথকে ঠিকানা দিয়েছেন। বস্তুত সোমেন দার পরামর্শেই আমি কলকাতা থেকে ভোটার লিস্টে নাম তুলেছিলাম। সে সময়ে আমি তো ফেরার। ভোটার তালিকায় আমার নাম নেই। এ সব ব্যাপারে তো বরাবরই গুছনো কাজ করতেন বামেরা। তখন সোমেন দা বললেন, অধীর তুমি এক কাজ করো, আমার আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ির ঠিকানায় ভোটার লিস্টে নাম তুলে রাখো। নইলে তুমি ভোটে লড়তেই পারবে না। আমি তাই করলাম।

কিন্তু রাজনীতিতে শুধু সিপিএমই তো বাধা দেয়নি। কংগ্রেসের ভিতর থেকেও বাধা এসেছিল প্রচুর। ভোটার তালিকায় নাম তো উঠে গেল। কিন্তু ৯৬ সালে কংগ্রেসেরই কিছু নেতা নেত্রী আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন, যাতে টিকিট না পাই। ওঁরা বললেন, অধীর চৌধুরী সমাজবিরোধী। ওঁকে টিকিট দেওয়া যাবে না। আমাকে, শঙ্কর সিং, সুলতান আহমেদ, মৃণালকান্তি সিংহকে টিকিট দেওয়া হলে আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সোমেন দা অবশ্য দমলেন না। তখন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন নরসিংহ রাও। সোমেন দা দিল্লিতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। আমাকে টিকিট দেওয়ার ব্যাপারে নরসিংহ রাওকে রাজিও করালেন।

আমি টিকিট পেলাম। কিন্তু নবগ্রামে যেতে পারছি না। আমার যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না আদালত। আমার হয়ে প্রচারের জন্য তখন সোমেন দাই তিনজনকে নবগ্রামে পাঠালেন—মদন মিত্র, বিল্টু দা (বিনোদানন্দ দা) ও হাওড়ার আবতাবউদ্দিন। ওরা আমার বক্তৃতার ক্যাসেট বাজিয়ে মাইকে প্রচার করলেন। খেজুর গাছে, তাল গাছে মাইক বেঁধে জোর প্রচার চলেছিল প্রায় পনেরো কুড়ি দিন ধরে। সোমেন দা সেদিন পাশে থাকার কারণেই আমি বিধায়ক হয়েছিলাম। ওখানে আমার লোকবল ছিল, জন সমর্থন ছিল, সম্ভাবনা ছিল। শুধু সুযোগ করে দিচ্ছিলেন না কেউ। সেটা সোমেন দা করে দিয়েছিলেন। আমার হাতে যেন কোয়েশ্চেন পেপার ধরিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে বলেছিলেন, উত্তর জানা থাকলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরীক্ষা দাও। ঠিক পাশ করবে।

সোমেন মিত্রের মাহাত্ম্য এখানেই। তিনি ছিলেন একজন বিরল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমি ও আমার মতো বহু কংগ্রেস কর্মীর মাথার উপর ছাতার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সোমেন মিত্র হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মাস লিডার তথা জননেতা ছিলেন না। কিন্তু কর্মীদের অসম্ভব প্রিয় ছিলেন তিনি। সহকর্মীদের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল সহযোদ্ধার মতো। তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর পার্টিম্যান। তাঁর রাজনৈতিক সত্ত্বার মধ্যে বামপন্থী ঘরানা বিরাজ করত।

৯৬ সালের ভোটে আমি জিতে যাওয়ায় সোমেনদার পক্ষেও ভাল হল। কারণ, তিনিই আমার টিকিটের জন্য দৌত্য করেছিলেন। আমি হেরে গেলে ওঁকে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে পড়তে হতো। দেখতে দেখতে তিন বছর প্রায় কেটে গেল। আমার মুর্শিদাবাদের কংগ্রেসি বন্ধু ও অনুগামীরা নতুন আবদার জুড়লেন। ওঁরা সোমেনদাকে গিয়ে বললেন, ৯৯ সালের লোকসভা ভোটে বহরমপুর আসন থেকে অধীর চৌধুরীকে প্রার্থী করলে কেমন হয়! শুনে সোমেনদা বলেছিলেন, আরে ওই সিট তো খারাপ সিট। ২ লক্ষ ভোটে কংগ্রেস হেরেছে।

সোমেনদা আমাকে ডেকে বললেন, অধীর তুমি কি দাঁড়াতে চাও? কারণ, তুমি দাঁড়াতে চাইলে সেটা আমার কাছে প্রায়োরিটি। তুমিই টিকিট পাবে। আমি বললাম, ঠিক আছে দাদা। সুযোগ দিন। সোমেন দা যে আস্থা রেখেছিলেন, তার অমর্যাদা করিনি। বহরমপুরে ২ লক্ষ ভোটে হারা সিটে জিতেছিলাম।

সোমেন মিত্রর অবদান তাই আমার জীবনে অপরিসীম। উনি না থাকলে আমি রাজনৈতিক পরিচয়টাই পেতাম না। এ কথা স্বীকার করে নিতে কোনও দ্বিধা নেই। বরং এই কথাটাই আজ সব থেকে বেশি মনে পড়ছে আমার। ফিরে ফিরে আসছে সেই সব দিনের স্মৃতি। রাজনীতিতে একজন অভিভাবক পেয়েছিলাম আমি। একজন স্নেহশীল দাদা। একজন সহযোদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.