আসুন দেখে নিই ৩৭০ ধারা কী !!!!

Spread the love

প্রতিবেদন,অয়ন বাংলা:- ৩৭০ ধারা কী !!!!!!
৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। এই ধারাবলে জম্মুকাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছেদ ১ ব্যতিরেকে) এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। এই ধারা বলে ওই রাজ্যে সংসদের ক্ষমতা সীমিত। ভারতভুক্তি সহ কোনও কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ রাখার জন্য রাজ্যের মত নিলেই চলে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের একমত হওয়া আবশ্যক। ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশ ভারতকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভাজন করে ভারতীয় সাংবিধানিক আইন কার্যকর হওয়ার সময়কাল থেকেই ভারতভুক্তির বিষয়টি কার্যকরী হয়।

স্বাধীনতার পর প্রায় ৬০০টি রাজন্য পরিচালিত রাজ্যের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা হয়। ওই আইনে তিনটি সম্ভাবনার কথা রয়েছে। প্রথমত স্বাধীন দেশ হিসেবে থেকে যাওয়া, দ্বিতীয়ত, ভারতের যোগদান অথবা, পাকিস্তানে যোগদান। এ ব্যাপারে কোনও লিখিত ফর্ম না থাকলেও, কী কী শর্তে এক রাষ্ট্রে যোগদান করা হবে, তা রাজ্যগুলি স্থির করতে পারত। অলিখিত চুক্তি ছিল, যোগদানের সময়কালীন প্রতিশ্রুতি রক্ষিত না হলে, দু পক্ষই নিজেদের পূর্বতন অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে।
অন্যান্য বেশ কিছু রাজ্য এই বিশেষ সুবিধা ভোগ করে সংবিধানের ৩৭১, ৩৭১ এ ও ৩৭১ এল ধারার মাধ্যমে।

ভারতভুক্তির শর্ত হিসেবে জম্মু কাশ্মীরে সংসদ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ- এই তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাধর। কাশ্মীরের ভারতভুক্তির ৫ নং উপধারায় জম্মু-কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্পষ্টত উল্লেখ করে দিয়েছিলেন যে তাঁর সম্মতি ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা আইনে এ রাজ্যের ভারতভুক্তি কোনও সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বদলানো যাবে না। ৭ নং উপধারায় বলা ছিল যে এই ভারতভুক্তির শর্তাবলী ভবিষ্যৎ কোনও সংবিধানের মাধ্যমে বদলাতে বাধ্য করা যাবে না।

ভারতভুক্তি কীভাবে হল?

রাজা হরি সিং প্রাথমিক ভাবে স্থির করেছিলেন তিনি স্বাধীন থাকবেন, এবং সেই মোতাবেক ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে স্থিতাবস্থার চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। পাকিস্তান সে চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছিল। কিন্তু জনজাতি এবং সাদা পোশাকের পাক সেনা যখন সে দেশে অনুপ্রবেশ করে, তখন তিনি ভারতের সাহায্য চান, যা শেষপর্যন্ত কাশ্মীরের ভারতভুক্তি ঘটায়। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরদিন, ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭, গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সে চুক্তি অনুমোদন করেন।

এ ব্যাপারে ভারতের অবস্থান ছিল খোলামেলা। ভারতের বক্তব্য ছিল এই ভারতভুক্তির বিষয়টি কোনও একজন শাসকের মতামতের ভিত্তিতে স্থির হতে পারে না, এর জন্য সে জায়গার অধিবাসীদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, “আমার সরকার মনে করে, কাশ্মীর আক্রমণকারীদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই সে রাজ্যের ভারতভুক্তির বিষয়টি রাজ্যের অধিবাসীদের দ্বারা স্থিরীকৃত হওয়া উচিত।” কাশ্মীরের ভারতভুক্তি যে সাময়িক সিদ্ধান্ত, তা ১৯৪৮ সালে জম্মু-কাশ্মীর সম্পর্কিত শ্বেত পত্রে ঘোষণা করে ভারত সরকার। ১৭ মে ১৯৪৯ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গারের সম্মতিক্রমে জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাকে একটি চিঠি লেখেন। সে চিঠিতে তিনি বলেন, ভারত সরকারের স্থির সিদ্ধান্ত হল জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান সে রাজ্যের অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়। সেই মতামতের প্রতিনিধিত্ব বহন করার উদ্দেশ্যেই গণপরিষদ গঠিত হয়েছে।

৩৭০ ধারা কীভাবে কার্যকর হয়েছিল?

মূল খশড়া দেওয়া হয়েছিল জম্মু কাশ্মীর সরকারকে। কিছু অদলবদলের পর ৩০৬ এ ধারা (বর্তমান ৩৭০) ২৭ মে, ১৯৪৯ সালে গণপরিষদে পাশ হয়। প্রস্তাব পেশ করে আয়েঙ্গার বলেন, যদিও ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও ভারতের তরফ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে যে পরিস্থিতি তৈরি হলে গণভোট নেওয়া হোক, এবং গণভোটে ভারতভুক্তি যদি গৃহীত না হয়, তাহলে “আমরা কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করব না।“

৩৭০ ধারা কি সাময়িক অবস্থান?

সংবিধানের একবিংশ অংশের প্রথম অনুচ্ছেদ এটিই। এ অংশের শিরোনাম হল- সাময়িক, পরিবর্তনসাপেক্ষ, এবং বিশেষ বিধান। ৩৭০ ধারাকে সাময়িক বলে বিবেচনা করা যেতেই পারে। জম্মু কাশ্মীর বিধানসভা এ ধারা পরিবর্তন করতে পারত, একে বিলোপ করতে পারত বা একে ধারণ করতে পারত। বিধানসভা একে ধারণ করার পক্ষে মত দেয়। আরেকটি ব্যাখ্যা হল- গণভোট না হওয়া পর্যন্ত ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত সাময়িক বলে গণ্য। গত বছর সংসদে এক লিখিত জবাবে ভারত সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির কোনও প্রস্তাব নেই। ৩৭০ ধারা সাময়িক এবং একে বহাল রাখা সংবিধানের সঙ্গে জালিয়াতি- এ কথা বলে মামলা করেছিলেন কুমারী বিজয়লক্ষ্মী। ২০১৭ সালে এ মামলা নাকচ করে দেয় দিল্লি হাইকোর্ট।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, শিরোনামে সাময়িক লেখা থাকলেও ৩৭০ ধারা সাময়িক নয়। ১৯৬৯ সালে সম্পৎ প্রকাশ মামলায় ৩৭০ ধারাকে সাময়িক বলে মানতে অস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট।
৩৭০ ধারা কি বিলোপ করা যেতে পারে?

রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে অনুচ্ছেদ ৩৭০ (৩) বিলোপ করা যেতেই পারে। তবে তেমন নির্দেশের জন্য জম্মু কাশ্মীরের গণপরিষদের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫৭-তে। ফলে একটা মত হল, ৩৭০ ধারা আর বিলোপ করা যেতে পারে না। তবে এ ব্যাপারে আরেকটি মতও রয়েছে, সেটা হল রাজ্য বিধানসভার সম্মতিক্রমে এই বিলোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে ৩৭০ ধারার তাৎপর্য কী?

৩৭০ ধারার ১ নং অনুচ্ছেদ উল্লিখিত হয়েছে, যেখানে রাজ্যগুলির তালিকায় জম্মু-কাশ্মীরকে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে ৩৭০ ধারার মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরে সংবিধান লাগু হবে। তবে ১৯৬৩ সালের ২৭ নভেম্বর নেহরু লোকসভায় বলেছিলেন যে ৩৭০ ধারার ক্ষয় হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরে ভারতীয় সংবিধান কার্যকর রাখার জন্য অন্তত ৪৫ বার ৩৭০ ধারা ব্যবহার করা হয়েছে। এ ভাবে রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রায় নাকচ করা হয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্দেশ মোতাবেক প্রায় গোটা সংবিধানই, সমস্ত সংশোধনী সহ জম্মু-কাশ্মীরে কার্যকর করা হয়েছে। ৯৭টির মধ্যে ৯৪টি যুক্তরাষ্ট্রীয় তালিকা জম্মু কাশ্মীরে লাগু, ৩৯৫ টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ২৬০টি রাজ্যে কার্যকর, ১৩টির মধ্যে ৭টি তফশিলও লাগু রয়েছে সেখানে।
জম্মু কাশ্মীরের সংবিধান সংশোধনের জন্য ৩৭০ ধারাকে একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে যদিও ৩৭০ ধারার অন্তর্গত ভাবে রাষ্ট্রপতিরও সে ক্ষমতা নেই। পাঞ্জাবে এক বছরের বেশি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি রাখতে সরকারের ৫৯তম, ৬৪ তম, ৬৭ তম এবং ৬৮তম সংবিধান সংশোধনী প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু জম্মুকাশ্মীরের ক্ষেত্রে শুধু ৩৭০ ধারা প্রয়োগ করেই সে কাজ চলে যায়। তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলির জন্য আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ২৪৯ নং অনুচ্ছেদ জম্মু কাশ্মীরে লাগু করার জন্য বিধানসভায় কোনও প্রস্তাব পাশ করানো হয়নি, রাজ্যপালের সুপারিশের ভিত্তিতেই তা কার্যকর হয়ে যায়। এসব দিক থেকে দেখলে ৩৭০ ধারা জম্মু কাশ্মীরের অধিকারকে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় খর্ব করে। এখন ৩৭০ ধারা, জম্মু কাশ্মীরের থেকে ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে বেশি সহায়ক।

জম্মু কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার জন্য ৩৭০ ধারার কি কোনও প্রয়োজন আছে?

জম্মু কাশ্মীরের সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে যে জম্মু কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধানের প্রস্তাবনায় কোনও সার্বভৌমত্বের কথা তো বলাই নেই, বরং সংবিধানের উদ্দেশ্য হিসেবে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির কথা বলা রয়েছে। এ রাজ্যের জনগণ স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে স্বীকৃত, নাগরিক নয়। ৩৭০ ধারা সংহতি বিষয়ক নয়, স্বায়ত্তশাসন বিষয়ক। যাঁরা এর বিলোপ চাইছেন, তাঁরা সংহতি নিয়ে ভাবিত নন, তাঁদের মাথাব্যথা অভিন্নতা নিয়ে।

৩৫ এ ধারা কী?

৩৭০ ধারা থেকেই প্রবাহিত হয়েছে ৩৫এ ধারা, যা ১৯৫৪ সালের রাষ্ট্রপতির নির্দেশের মাধ্যমে কার্যকর হয়। ৩৫এ ধারানুসারে, জম্মু কাশ্মীরের বাসিন্দা বলতে কী বোঝায়, তাঁদের বিশেষ অধিকারগুলি কী কী, এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জম্মু কাশ্মীর বিধানসভার উপর ন্যস্ত রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.