কেন রাজনীতিতে যোগ দিলেন কেন,তৃণমূলে গেলেন জানালেন প্রাক্তন আই পি এস হূমায়ুন কবীর

Spread the love

হূমায়ুন কবীর :-    হালফিলের মধ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং পরবর্তী পর্যায়ে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তস্রোতে ভেসে যে দলের উত্থান তারাই গুজরাত দাঙ্গা কিংবা দিল্লীর দাঙ্গা বাঁধিয়ে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বিভেদের বিষ ছড়িয়ে এবং নকল উগ্র জাতীয়তাবাদ সহ নানান ছল চাতুরির মাধ্যমে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আমদানি করে ভারতবর্ষে ক্ষমতায় আসীন তারাই আজ পশ্চিম বাংলা দখল করতে চাইছে, তা আপামর বাঙালীর হাড় হিম করার পক্ষে যথেষ্ট। তাদের এই রক্তের হোলি খেলার বিচারও বসেছে সময়মত কিন্তু সেগুলো প্রহসন ছাড়া কিছুই ছিল না। সংবিধানের শপথ নিয়ে মন্ত্রী কিংবা সাংসদ মহোদয়রা কিভাবে দেশের মানুষকে দেশোদ্রহী হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে গোলি মারার নিদান দিতে পারেন সেই প্রশ্ন হয়তো কয়েকজন তুলেছেন কিন্তু সেই বক্তাদের বিরুদ্ধে কেন আইন মেনে কেস রুজু হল না তার কোন উত্তর রয়েছে? অথচ JNU কিংবা জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র আন্দোলনকে বারে বারে দেশদ্রোহ তকমা দিয়ে দেশের ছাত্রদের চূড়ান্ত হয়রান করতে আমরা দেখেছি কিন্তু প্রতিবাদে গর্জে উঠতে পারিনি UAPA-এর ভয়ে। ভারতবর্ষে আজ উগ্র জাতীয়তাবাদের হুঙ্কার চূড়ান্ত রূপে প্রতিষ্ঠার অনুশীলন চলছে, মুসলমান, দলিত এবং তপশীল জাতি-উপজাতির উপর বিদ্বেষ চরম আকার ধারন করেছে, তাদের এমনভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হতে আমি আগে কখনও দেখিনি। হয় তুমি রামজাদা নয়তো হারামজাদা! এর মাঝে আর কেউ নেই, কিছু নেই! রামের সমর্থন না করলে তুমি পাকিস্তানি!

যে দলের জন্ম ১৯২৫ সালে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে তাদের ইতিহাস বলে ইংরেজদের চাটুকারিতা আর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে দিয়ে তারা বেড়ে উঠেছে। আজ ক্ষমতা এবং রক্তের স্বাদ পেয়েছে তাই তাদের একমাত্র অ্যাজেন্ডাম আমাদের দেশের সংবিধানের মূলকথা- সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রিপাবলিক ধ্বংস করে ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সেই লক্ষ্যে যে বিষ গাছ তারা ঘরে ঘরে রোপন করছে সেই বিষ গাছ একদিন বিশাল বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়ে আমাদের সমাজকে গ্রাস করবে।

গোরক্ষার ধুয়ো তুলে বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে মুসলমান এবং দলিতদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা থেকে তাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে সর্বোতভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে তা বেনজির এবং এককথায় অকল্পনীয়। পরবর্তিকালে NPR & NRC-র মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার যে ষড়যন্ত্র চলছে তা রীতিমতো ভীতিপ্রদ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের মাধ্যমে উঠে আসা এইসব ফেকু সন্ন্যাসীদের দৌরাত্মে বিগত প্রায় দু’দশক জুড়ে ভারতবর্ষের গোবলয়ে যে তান্ডব, যে গণতন্ত্রের ধ্বংসলীলা আমরা দেখছি, যেভাবে মানুষের কন্ঠরোধ আমরা প্রত্যক্ষ করছি তার চাইতেও বড় কোন হিডেন অ্যাজেন্ডা রয়েছে তাদের ঝুলিতে। যে রাজ্যে ৩০ শতাংশের বেশী মুসলমান, ২৭ শতাংশের বেশি তপশিলি জাতি-উপজাতির মানুষের বাস সেই রাজ্যে তারা ক্ষমতায় এলে গৃহযুদ্ধ এবং বাস্তবের রক্তগঙ্গা বইবার আশঙ্কা অমূলক নয়! রাজ্যে রাজ্যে তাদের নেতারা যেভাবে মুসলমান এবং দলিত বিদ্বেষ গর্বের সঙ্গে বার বার প্রকাশ্যে প্রকট করে চলেছেন তা আমরা নিত্যদিন চাক্ষুষ করছি কিন্তু আমাদের মত সাধারন মানুষ প্রতিবাদ করার ভাষাটুকু জোগাড় করার সাহস দেখাতে পারিনি।

মধ্যপ্রদেশে জেল থেকে পালানোর নাটক রচনা করে বিনা বিচারে কিংবা উত্তরপ্রদেশে দিনের পর দিন নানান আছিলায় কিভাবে দলিত এবং মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে তা কি আমরা প্রত্যক্ষ করছি না! জম্মুর কাটুয়াতে একটি নাবালিকাকে লাগাতার আট দিন ধর্ষন করে হত্যা করা হল, সেই কেসে অভিযুক্ত আসামীরা ধরা পড়ল এবং বেল পেয়ে বেরিয়ে এল কিছু দিন পর সেটা যদি স্বাভাবিক বলে মেনেও নিই কিন্তু সেই অভিযুক্তদের নিয়ে এই দলের নেতাদের ফুলের মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে রাজপথে মিছিলের আস্ফালন কি মেনে নেওয়া যায়! তারা অমানুষ কিংবা দেশদ্রোহী নয়?

দিল্লি রায়টের পর দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতির নির্দেশ হল কয়েক জনের বিরুদ্ধে এফ আই আর রুজু করার কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম সেই বিচারপতিকে রাত দুটোতে বদলি হতে! সেই এফ আই আর কি আজও হয়েছে? বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিচার আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করলাম, বন্ধুরা সেটা কেমন বিচার ছিল? সুপ্রিম কোর্টের সেই বিচার ক’জন বিবেকবান মানুষ সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন? অন্যান্য প্রতিষ্ঠান? সি বি আই, ই ডি, এন আই এ, আই টি, দিল্লি পুলিশ কিংবা উত্তর প্রদেশ পুলিশ কি নিরপেক্ষ?

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ভিডিও আজও দেশে-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে এবং ইউ টিউবে জ্বল জ্বল করছে কিন্তু সেই ঘটনার নাকি কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই তাই আদবানিরা বেকসুর ছাড়া পেয়ে গেলেন! বিচারের রায় ঘোষনার পর অভিযুক্তদের প্রকাশ্য রাজপথে উল্লাস এবং এরকম ঘটনা বার বার ঘটাবার আস্ফালন চাক্ষুষ করলাম তাতে কি নিরপেক্ষ বিবেক কেঁপে ওঠেনি! তারা কি বিবেকের কাছে পরিস্কার? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শিক্ষিত মানুষের হয়তো অভাব নেই তবে শিক্ষিত বিবেকের বড্ড অভাব রয়েছে। তাঁর কথা এতদিন পরেও বড্ড প্রাসঙ্গিক!

হালফিলের মধ্যে উত্তর প্রদেশের দাদরির মহম্মদ আখলাক, হরিয়ানায় ওখলা-আসোটি ট্রেনে হাফিজ জুনাইদের খুন কিংবা রাজস্থানের আলোয়ারে পেহেলু খানকে পিটিয়ে মারার মত বহু ঘটনা কাদের সাহসে কাদের উস্কানিতে ঘটেছে তা কি সাধারন মানুষের অজানা? লোক দেখান কিছু গ্রেফতার এবং তাদের ছাড়া পাওয়ার পর তাদের ফুলের মালা পরিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে উল্লাস কিসের ইঙ্গিত?

২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘সবকা সাথ – সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ কিন্তু বাস্তবে আমরা কি প্রত্যক্ষ করছি! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের ক’জন বিশ্বাস করেন? আর সংখ্যালঘুরা? এসব কথা সব লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে আর সেই মেধা কিংবা ধৃষ্টতা আমার নেই। এই যুগপুরুষ গুজরাট দাঙ্গার কয়েক মাস পরে রিলিফ ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, এখনও ক্যাম্প কিসের? বাচ্চা পয়দা করতে কি? কে তাঁকে বোঝাবে যাদের চোখের সামনে তাদের প্রিয়জনকে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে, কিংবা যারা তাদের মা-বোনেদের ধর্ষিত হতে দেখেছে, ঘর বাড়ি পুড়তে দেখেছে, পেশা থেকে শুরু করে সর্বস্ব হারানো এইসব মানুষের ব্যথা (ট্রমা) বুঝতে গেলে মানুষ হতে হবে, যুগপুরুষরা কি আর এই ব্যথা বুঝতে পারবেন!

২০১৯ সালে CAB পেশের সময় ভিটে মাটি হারানোর আতঙ্কে সাধারান কিছু মানুষরা যখন আন্দোলন চালাচ্ছিলেন তাদের (যদিও আইন হাতে তুলে নেওয়া কোন অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়) উদ্বেগের কথা ভুলে এই মহাপুরুষ তাদের পোষাক দেখে দিব্য চিনে নিয়েছিলেন, হায় তাদের উদ্বেগ আর মনের অনিশ্চয়তা যদি একই দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেতেন! জুমলা বাজির জন্য যদিও তিনি ইতিমধ্যেই সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেছেন, পুরুষ থেকে সিদ্ধ পুরুষে তাঁর উত্তরণও ঘটেছে! তাইতো খ্যাতির চূড়ায় উঠে মাটির উপর আজ কৃষকদের উদ্বেগ আর যন্ত্রনা পরখ করবার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। তাই কৃষকরা আজ খালিস্তানি এবং দেশদ্রোহী। কৃষি- আইন নাতো কোন বেদ বাক্য, নাতো বাইবেলের বানী নাতো কোরানের আয়াত তাহলে এত জেদ কিসের? কেন তুলে নেওয়া যায় না?

মানুষের সামনে ‘আচ্ছে দিনের’ ললিপপ স্বপ্নের ফেরিওয়ালার মুখ থেকে আমরা বার বার শুনে এসেছি। সত্যিকারের আচ্ছে দিনের আজও অপেক্ষায় রয়েছি। পেট্রোল-ডিজেলের দাম, রান্নার গ্যাস থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনেসের ঊর্ধ্বগামী দাম কি ‘আচ্ছে দিনের’ সূচক?

স্তাবক আর চাটুকার পরিবেষ্ঠিত হয়ে রাজা ভুলে গেছেন একদিন সাধারন মানুষ জিজ্ঞাসা করতে পারে ‘রাজা তোমার কাপড় কোথায়’?

আমি নিজেকে বিবেকবান এবং ধর্ম নিরপেক্ষ বলে মনে করি তাই ধর্মের নামে বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতায়নকে মেনে নিতে পারি না। সব বন্ধুদের সবসময়ের জন্য দেশের সব আইন কানুন মেনে বিবেক জাগ্রত রেখে পথ চলেতে বলি, নিজেও সেই চেষ্টাই নিরন্তর চালিয়ে যাই। মানুষের মধ্যেই আমি আল্লা-ঈশ্বর-গড খুঁজে বেড়াই, ‘দেবতা এদেশে মানুষ হয়েছে জানি, মানুষকে দেখি গনদেবতার বেশে’।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে কিছু লোভী কিংবা খারাপ মানুষ নিশ্চয়ই রয়েছেন তা বলে তাঁর মানুষের পাশে থাকার নিরন্তর প্রয়াস, তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত স্বাস্থসাথী, খাদ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রুপশ্রী, সবুজসাথী, যুবশ্রী এমন হাজারো প্রকল্পের ডালি মেলে ধরা কিংবা কোভিড অতিমারি, আম্ফান ঘূর্নিঝড়, বন্যা-খরা, সব ধর্মের সব ধরনের মানুষের সঙ্গে সব ধরনের দুখ-কষ্টে বছরের ৩৬৫ দিন সঙ্গে থাকা আর কোন নেতা-নেত্রী কি করে দেখিয়েছেন?

আব্বাস সিদ্দিকি ভাইজান নিশ্চয়ই তাঁর ফিল্ডে গুনী মানুষ কিন্তু রাজ্য চালানোর দক্ষতা কি তাঁর রয়েছে? তিনি একজন ধর্মীয় পথের দক্ষ দিশারি কিংবা পাইলট হতেই পারেন কিন্তু রাজনীতির খানা খন্দে ভরা গরু গাড়ির গাড়োয়ান কি উনি হতে পারবেন? ক’মাস আগের বিহারের ভোটে মিমের মত ভোট কাটুয়ার ভূমিকা নিয়ে একটা সর্বগ্রাসী, আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক দলের সুবিধা করে দিয়ে পরে হাত কামড়ালে আমারা তাঁকে ক্ষমা করার জায়গায় থাকবো তো? আমাদের সবার ভিটেমাটি থাকবে? আপনি নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতে পারেন, এই সাম্প্রদায়িক দলকে আটকানোর দায়িত্ব কি শুধু মুসলমানদের? আমি বলি, না। এই গুরুদায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বিবেকবান মানুষের উপর বর্তায় তবে এখন এই গুরুদায়িত্ব বেশী করে মুসলমান আর দলিতদের উপর! এই সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতায় এলে সব মানুষের বেশ কিছু ক্ষয়-ক্ষতি হবে, সাধারন মানুষের জন জীবনেও বিভিন্ন বিপর্যয় নেমে আসবে তবে তাদের প্রান কিংবা ভিটে-মাটি কিংবা সবকিছু খোয়া যাবে না, তাদের মা-বোনেদের ইজ্জত যাবে না, কিন্তু মুসলমানদের? দলিতদের? তখন সেই রক্ষাকর্তা হিসাবে গুরুদায়িত্বের বোঝা নিজের জঙ্ঘা নাচান ভাইজান নিজের কাঁধে তুলে নেবেন তো? তাঁর কাঁধ কি যথেষ্ট মজবুত? ক্ষমতায় কুলোবে বলে আপনাদের মনে হয়? অন্যের ফুঁ দেওয়া হাওয়া কিন্তু আসন্ন ভোটের মাত্র তিনটা মাস, ৩৬৫ দিনের পাঁচ পাঁচটা বছর নয়! দাঁড়ানোর মাটিটুকু অন্তত চাই, নাহলে কিভাবে রবীন্দ্রনাথের মত ‘প্রশ্ন’ করব ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’

তাই তাদের এই রাজ্য থেকে দূরে রাখতে আমাদের এই রাজ্যের সবচাইতে লড়াকু এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসে আমার যোগদান। ফেক এবং বানাওটি বাইরের এই বিরোধী দলের সোশ্যাল মিডিয়া সেল পয়সার জোরে বেশ শক্তিশালী, আমার দিকে কাদা ছোঁড়া শুরু করেছে, আগামী দিনে আক্রমণের ঝাঁঝ আরও বাড়বে তাতে আপনারা বিচলিত হবেন না, আমি এবং আমার জমির খুবই দৃঢ়, আমার চিত্ত ভয়-ডরহীন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.