রাজেশ সাহা, কলকাতা: দক্ষিণ দিল্লির শাহিনবাগ থেকে কলকাতার পার্ক সার্কাসের দূরত্ব প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার। প্রথমটি দেশের রাজধানী, দ্বিতীয়টি পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। তবে এই মুহুর্তে পার্ক সার্কাস ময়দানেই যেন উঠে এসেছে এক টুকরো শাহিনবাগ। দুই রাজ্যের মধ্যে সুদূর ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দুটি শহরকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে ‘আজাদি’র স্লোগান। এ যেন স্বাধীন দেশেই নতুন করে পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার আন্দোলন। রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি থেকে স্বাধীন হতে চান ওঁরা। বিভাজনের প্রচেষ্টা ও কৌশল থেকে মুক্তি পেতে চান, চান ধর্মের নামে আগ্রাসন থেকে মুক্তি। সেকারণেই পার্ক সার্কাস ময়দানে নিজেদের ধর্ম ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধর্নায় বসেছেন হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সহ একাধিক ধর্মের মহিলারা। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে এই লাগাতার আন্দোলন। সকলের একটাই দাবি, এনআরসি, সিএএ মানবো না। আমরা সকলেই ভারতের নাগরিক। নতুন করে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেব না।
রবিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা গেল শীতের পড়ন্ত বিকেলে মাথার পেছনে হাওয়ায় উড়ছে প্রায় আট ফুট লম্বা তেরঙ্গা। মাঠের মাঝখানে শতরঞ্জি পেতে ঠাই বসে প্রায় শ’তিনেক মহিলা। কারও কোলে একরত্তির শিশু আবার কেউ রান্না ফেলে চলে এসেছেন আন্দোলনে যোগ দিতে। আজাদির স্লোগানরত মহিলাদের মানববন্ধন করে ঘিরে রেখেছেন পুরুষরা। মাঠের চারদিকে শুধুই জাতীয় পতাকা। কোথাও কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা নেই। নেই কোনও রাজনৈতিক দলের স্লোগান। আর মাঠের মাঝখানে দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে মাইক নিয়ে গগনমুখী হাত উঁচিয়ে উচ্চস্বরে স্লোগান দিয়ে চলেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। তাঁদের সুরে সুর মিলিয়ে কোরাস তুলছেন উপস্থিত মহিলা-পুরুষ সকলে।
পরপর চার রাত জেগে ক্লান্ত ব্রড স্ট্রিটের বাসিন্দা ইভানা নাজির বলেন, “আমরা কেউ এর আগে কখনও কোনও আন্দোলন করিনি, জীবনে কোনওদিন রাজনীতিও করিনি। কিন্তু আজ দেশ বাঁচতে সংসার ফেলে চলে এসেছি। আজ রাস্তায় না নামলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।” তাঁর পাশেই দাঁড়ানো আয়েশা বেগম বললেন, “আমি প্রথম দিন থেকে এই আন্দোলনে রয়েছি। পালা করে রাত জাগছি। আমার এই সিদ্ধান্তের পাশে পেয়েছি আমার স্বামীকেও। তিনিও এখানে নিয়ম করে হাজির থাকছেন, আমাদের উৎসাহ দিচ্ছেন।” শুধু ইভানা বা আয়েশারাই নন, এই ধর্নায় সামিল হয়েছেন সব বয়সের মানুষ। কিছুদিন আগেই রাত জেগে আজাদির স্লোগান দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এক ক্ষুদের ভিডিও। তাকে দেখে উৎসাহিত হয়ে ভিড় জমিয়েছে আরও বহু কচিকাঁচা। তারা জানে না এনআরসির অর্থ, জানে না সিএএ-র মানে তবু বাবা মায়ের সঙ্গে বসেই বিড়বিড় করে চলেছে আজাদির স্লোগান।
কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে এই আন্দোলনের ডাক প্রথম দিয়েছিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাসিন্দা বছর বিয়াল্লিশের আসমা জামিল। এলাকার সমাজসেবী এই গৃহবধূর কয়েক মাস আগেই কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। এখনও শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। নিয়ম করে চেক আপে যেতে হচ্ছে চিকিৎসকের কাছে। সেই অসুস্থতা উপেক্ষা করে ঠায় বসে রয়েছেন ময়দানে। শুক্রবারই এক দফায় ডাক্তার দেখিয়ে ফের যোগ দিয়েছেন ধর্নায়। পার্ক সার্কাস এলাকারই বাসিন্দা নিলুফা সাদিক বাড়ি ঘর ফেলে চলে এসেছেন। প্রথম দিন থেকে ধর্নায় বসা মহিলাদের নিয়ম করে বিতরণ করছেন জল ও বিস্কুট। “তিন বেলা সংসার সামলে এখানে আসছি, সবাইকে জল ও বিস্কুট দিচ্ছি, এভাবেই পাশে থাকার চেষ্টা করছি”, বললেন নিলুফা।
এনআরসি ও সিএএর বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার থেকে। দিন রাত সবসময় অনবরত স্লোগানে স্লোগানে প্রতিবাদ চলছে। রবিবার ষষ্ঠ দিনে পা দেওয়া এই ধর্না অনির্দিষ্টকালের জন্য চলবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। নিজেদের মধ্যে কথা বলে রীতিমতো পালা করে রাত জাগছেন সকলে। পার্ক সার্কাস থেকে আন্দোলনকারীদের এই গর্জন দিল্লি পৌঁছাবে কিনা জানা নেই, তবুও কবীর সুমনের গানের ভাষায় “হাল ছেড় না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে” এই লক্ষ্যেই দাবি না মেটা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তেই অনড় প্রতিবাদী এই মুখগুলো।
সৌজন্য:-mahanagar 24*7