যাকাত বন্টন পরিকল্পনা অনুযায়ী হওয়া দরকার
তায়েদুুল ইসলাম , প্রতিবেদন :- ইসলামের প্রধান পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত একটি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। যাকাত ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার ভিত্তি। মজবুত ও স্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামো ছাড়া কোন সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষের জীবনে অর্থের প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিক নিয়মেই ইসলামে অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইসলাম সমস্ত মানুষের জন্য একটি সার্বজনীন পূর্ণাঙ্গ গতিশীল জীবন ব্যবস্থা। ফলে এর অর্থ ব্যবস্থাও সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর। তাই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা বা যাকাতের কথা আলোচনার সময় এই ভাবে আলোচনা করা সঠিক নয় যে বর্তমান মুসলিম সমাজের উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা কী হওয়া উচিত। আলোচনা হওয়া দরকার যাকাত বা ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা কী ভাবে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। কী ভাবে পূঁজিবাদী এবং সমাজবাদী অর্থ ব্যবস্থার ত্রুটি মুক্ত বিকল্পধারার অর্থ ব্যবস্থা দিতে পারে। সেই জন্য পূর্ব অর্জিত সমস্ত রকম ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, বদ্ধমূল বিশ্বাস ও চেতনাকে সরিয়ে রেখে সম্পূর্ণ মুক্ত, উদার, নিরপেক্ষ মন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে তুলনামূলক পড়াশুনা করতে হবে বিভিন্ন রকম অর্থ ব্যবস্থা সম্পর্কে।
যাকাত ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ ছাড়াও অন্যান্য খাত আছে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য অভাব মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত থাকবে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার দর্শনগত ভিত্তি হল রাষ্ট্রের কোন সম্পদেরই মালিক মানুষ নয়। সমস্ত সম্পদের মালিক আল্লাহ। মানুষ সেই সম্পদের কেয়ারটেকার ও ব্যবহারকারী। মানুষ ইচ্ছামতো এই সম্পদ ব্যবহার করতে পারে না। অর্থাৎ ইচ্ছামতো যে কোন উপায়ে আয়ও করতে পারে না এবং ব্যয়ও করতে পারে না। সেই আলোকে বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাষ্ট্রের জনগণই রাষ্ট্রের সম্পদের মালিক। সরকার বা পরিচালকরা জনগণের কেয়ারটেকার। তারা জনগণের স্বার্থ বিরোধী কোন আইন তৈরি করতে পারে না।
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য যেহেতু দারিদ্র্য বিমোচন সেহেতু যাকাতেরও মূল উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন। সেই জন্য যাকাত সংগ্ৰহ ও বন্টন হতে হবে কেন্দ্রীয় ভাবে। ব্যয় করতে হবে উৎপাদন মূলক খাতে যাতে যাকাত গ্ৰহণকারী স্থায়ী ভাবে দারিদ্র্য মুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে। ভবিষ্যতে আরও পাঁচ জনকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে যে ভাবে যাকাত বিলিবন্টন হয় তাতে যাকাতের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে দেন। কেউ কেউ হিসাব না করে মোটামুটি একটা অংক দিয়ে দেন। তাতে যাকাতের পরিমাণের চেয়ে বেশি বা কম সম্পদ চলে যায়। আসলে তারা দান ও যাকাতের পার্থক্য বোঝেন না। যাকাত হল বাধ্যতামূলক দান । বাকি দান হল স্বেচ্ছাদান। যাকাত দানকারী যাকাতের মালিক নন। যাকাত গ্ৰহণকারীর অধিকার। অনেক সময় যাকাতের প্রকৃত হকদারেরা যাকাত পান না। অন্য দিকে যারা প্রকৃত হকদার নয় তারাও বেশি বেশি চাইতে পারার জন্য অনেক বেশি পেয়ে যায়। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে এই সময়ে অনেকেই বেশি পোশাক পেয়ে যাওয়ার ফলে বিক্রিও করে দেয়। এই সুযোগ গ্ৰহণ করার জন্য সাময়িক ভিখারির সংখ্যা বেড়ে যায়। স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করে এমন কাজে লাগানো হয় না। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন নতুন খাত তৈরি হলে সেখানেও ব্যয় করার কথা ভাবতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অঞ্চল ভিত্তিক একত্রে যাকাত সংগ্ৰহ করা। বেশির ভাগই ব্যয় করা দরকার কেবলমাত্র ঐ অঞ্চলেরই গরীবদের অভাব স্থায়ী ভাবে দূরীকরণে। নানা রকম কুটির শিল্পের কথা ভাবা যেতে পারে। বাকি অংশ জেলা বা রাজ্য ভিত্তিক কোন পরিকল্পনায় ব্যয় করা যেতে পারে। শিক্ষামূলক কর্মসূচি যেমন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্যমূলক কর্মসূচি যেমন হাসপাতাল, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গণমাধ্যম যেমন সংবাদ পত্র, দূরদর্শন, সমাজ মাধ্যম এই ধরনের পরিকল্পনা গ্ৰহন করলে সেখানে দান করতে হবে।
যাকাতের একটি খাত বর্তমানে নেই বলে মনে করা হয়। তা হল দাস মক্ত করার খাত। কিন্তু আমরা যদি একটু গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করি তা হলে উপলব্ধি করতে পারব সে খাত এখনও সমাজে চালু আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়কার বন্দির ধরণ পালটিয়েছে। সেই সময়ে বন্দিদের মুক্তির জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হতো আজকে সেই অর্থ ব্যয় করতে হবে জেল থেকে বা মামলা থেকে বন্দিদের মুক্ত করতে। যে সমস্ত নির্দোষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্র জেলখানায় বন্দি করে রেখেছে, যে সমস্ত সমাজকর্মীকে মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ করার অপরাধে জেল খাটতে হচ্ছে, মানবাধিকার কর্মী জেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন ,যে সমস্ত মুসলমানদেরকে মুসলিম হওয়ার অপরাধে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে তাদের জেল থেকে মুক্ত করার জন্য দাস মুক্ত করা খাতের টাকা ব্যয় করতে হবে।
ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রে অভিভাবকহীন নাগরিকদের, যেমন বৃদ্ধ বৃদ্ধা, অনাথ, শিশু, প্রতিবন্ধী এমনকি গৃহপালিত জন্তু সকলের দেখভালের দায়িত্ব সমাজ বা রাষ্ট্রের। সেই নিয়মে বর্তমান সর্দারি ব্যবস্থায় একজন সর্দারের দায়িত্ব তার অধীনস্থ অভিভাবকহীন নাগরিকদের সারা বছরের জন্য প্রয়োজন মেটানো। এলাকা ভিত্তিক একত্রে সংগ্ৰহ ও বন্টনের সময় ঐ এলাকার সমস্ত অভিভাবকহীন নাগরিকদের সমস্ত রকম প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্বও এলাকার পরিচালকদের। একত্রে সংগৃহীত ও বন্টিত হলে অভিভাবকহীন নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা সহজ হবে। এই ভাবে আমরা যদি অঞ্চল ভিত্তিক একত্রে যাকাত সংগ্ৰহ ও বন্টনের উদ্যোগ গ্ৰহন করি তা হলে সমাজে যাকাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হবে।