প্রসঙ্গ যখন মাদ্রাসায় জঙ্গি কার্যকলাপ!
প্রায় তেরো চৌদ্দ বছর আগের ঘটনা। সে সময় মাদ্রাসা ও হাইস্কুলের শিক্ষকতার চাকরি স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে হত। মুর্শিদাবাদের একটি গোড়া ব্রাহ্মন পরিবারের মেয়ে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বহরমপুর ব্লকেরই একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরি পান সেই বন্ধু। মাদ্রাসায় চাকরি পেয়েছে বলে, ওঁদের বাড়িতে হুলস্থুল কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। তাঁর আত্মীয়স্বজনরা মেয়েকে মাদ্রাসায় চাকরি না করার পরামর্শ দেন। ওদের পরিবারের লোকের বদ্ধমূল ধারণা, মাদ্রাসা মানেই লম্বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, টুপি পরা, কিছু মানুষের পড়াশুনার ক্ষেত্র। ওরা আরবি, উর্দু পড়ে। ওইসব জঙ্গীরা পড়ে!
বিষয়টি জানার পরে তাঁর প্রতি আমার পরামর্শ ছিল— ‘‘একবার মাদ্রাসায় গিয়ে দেখতে ক্ষতি কি? খারাপ লাগলে যোগদান করবে না।’’ শেষ পর্যন্ত সেই বন্ধু মাদ্রাসা দেখতে যান। সেখানে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান! প্রধান শিক্ষিকা অত্যন্ত আধুনিক এক মহিলা। অনেক শিক্ষক ও শিক্ষিকা অমুসলিম। বেশ কিছু ছাত্রী অমুসলিম। গোটা মাদ্রাসায় একজন মাত্র দাড়িওয়ালা মানুষ। মৌলভী। অন্য বিদ্যালয়ে সঙ্গে এই মাদ্রাসার সিলেবাসের বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। শুধুমাত্র ১০০ নম্বরের অতিরিক্ত আরবি ভাষা ও ইসলামিক স্টাডিজ। শেষ পর্যন্ত সেই বন্ধু ও তাঁর বাবা মা, আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। উনাদের বক্তব্য ছিল, “আসলে বাবা! মাদ্রাসা সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না।’’
শুধু বন্ধুর বাবা মায়ের নয়, মাদ্রাসা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। আবার অনেকের মাদ্রাসা সম্পর্কে ভুল ধারণা রয়েছে। ‘মাদ্রাসা’— সম্পর্কে ভুল ধারণার মূলে রয়েছে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অমুসলিমদের অজ্ঞতা ও উপেক্ষা।
মাদ্রাসা মূলত তিন প্রকার।
একটি হল, সরকারি অনুমোদিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হাই মাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসা। যার সব কিছুই সরকার নিয়ন্ত্রিত। স্কুলের সাথে হাইমাদ্রসার পার্থক্য হল, নবম দশম শ্রেণিতে অতিরিক্ত একশো নম্বরের ইসলাম পরিচয় এবং আরবি ভাষা। স্কুলের সাথে সিনিয়র হাইমাদ্রাসার পার্থক্য হল, সিনিয়র মাদ্রাসার সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষার ভাগ তুলনায় বেশি। এখানে আলিম হল মাধ্যমিক, ফাজিল উচ্চ মাধ্যমিক। মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের অধিকাংশই অমুসলিম। প্রায় দশ শতাংশের মত অমুসলিম ছেলেমেয়ে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আমাদের পাশের লালগোলার আইসিআর হাই মাদ্রাসায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকারী পড়ুয়াটি হল অমুসলিম। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মাদ্রাসা ও স্কুল একই সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়।
দ্বিতীয় ধরনের মাদ্রাসাগুলি হল সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত কিন্তু সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত। এগুলিও হাইমাদ্রাসার মত। তবে পড়ুয়ার সংখ্যা খুবই কম। এখানে শিক্ষকদের বেতন মানুষের দান ও পড়ুয়াদের বেতনে হয়।
তৃতীয় ধরনের মাদ্রাসাকে নিজামিয়া বা খারিজি মাদ্রাসা বলে। এগুলির কোনও সরকারি অনুমোদন নেই। অত্যন্ত গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এইসব মাদ্রাসায় পড়ে। এখানে থাকা খাওয়া সব বিনামূল্যে। এই মাদ্রাসা গুলি, মুসলিম সমাজের মানুষের যাকাত, ফেতরা ও দানেই চলে। এই সব মাদ্রাসায় উর্দু ও আরবি ভাষায় মূলত ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। তার সাথে বাংলা, ইংরেজি, ও অংক পড়ানো হয়। কিন্তু সমস্যা হল এই সব মাদ্রসার শিক্ষক ও শিক্ষিকার মান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাল হয় না। তাঁদের অনেকেই আরবি ভাষাতেও দক্ষ হন না। আরবি ভাষায় কথা বলতে, কোনও প্রবন্ধ লিখতে অধিকাংশ শিক্ষকরাই অপরাগ। তাঁদের বেতন তিন থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। সিলেবাসের কোনও আধুনিকীকরণ নেই। এই সব মাদ্রাসায় পড়া পড়ুয়াদের উন্নত ধর্মীয় জ্ঞান বা আরবি ভাষার উপর ব্যুৎপত্তি কোনওটিই লাভ হয় না। আবার আধুনিক বিষয়ে শিক্ষা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হয়। ( অবশ্যই দেশে দেওবন্দ, বা দারুল উলুম পরিচালিত কিছু উন্নত মানের ভাল মাদ্রাসা আছে।) এই খারিজি মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা করেই মৌলভী পদবি লাভ করেন। তাঁদের কাজ মুসলিমদের মধ্যে হাদীস ও কোরআনের আলোকে ইসলামকে ব্যাখ্যা করা, এবং শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়া। এইসব মাদ্রাসায় কোনও সরকারি বা বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি কোনওটিই নেই। এই মাদ্রাসাগুলির সিলেবাসে বড়সড় আধুনিকীকরণ দরকার, এবং এদের সরকারি অনুমোদনের পাশাপাশি নজরদারি আবশ্যিক।
এত কিছু অবতারণার মূলে আসা যাক। কেউ কেউ মাদ্রাসাকে জঙ্গিদের আতুড়ঘর হিসেবে দেখিয়ে থাকেন। তাঁদের মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেমন রয়েছেন, তেমনি দেশের শাসকদল বিজেপির একাধিক নেতামন্ত্রীও রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা আজ পর্যন্ত সেই সব মাদ্রাসাকে চিহ্নিত করে দিতে পারেননি।
২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, unregistered মাদ্রাসাগুলিতে সন্ত্রাসবাদী বা দেশবিরোধী কার্যকলাপ হয়ে থাকে। পুলিশমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের একটি মাদ্রাসাকেও চিহ্নিত করতে পারেননি যেখানে দেশ বিরোধী কার্যকলাপ হয়। যদি কোনও মাদ্রাসায় এমন কার্যকলাপ হয় তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে অসুবিধা কোথায়? উনি পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের অপমান করেছিলেন, এবং নিজের পদের অবমাননা করেছিলেন।
খাগড়াগড় কাণ্ডের সময়ও মাদ্রাসা সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকা সংবাদ মাধ্যম এবং এক শ্রেণির মানুষও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো আলপটকা মন্তব্য করেছিলেন। এনআইএ কয়েক বছর ধরে তদন্ত করেও চিহ্নিত করতে পারেনি যে, পশ্চিমবঙ্গের কোনও মাদ্রাসা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকটি মাদ্রাসা থেকে গ্রেফতার করা ব্যক্তিকেও প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিয়েছে। আসলে সবটাই ছিল ভুয়ো মামলা। আরবী শেখার প্রাথমিক বইকে ‘আল কায়দা’ কে দেখিয়ে এরাজ্যের প্রথম সারিতে থাকা এক সংবাদ মাধ্যম জঙ্গি সংগঠন আলকায়দার বই পাওয়া গিয়েছে প্রচার করেছিল। পরে অবশ্য তাঁরা ভুল শিকার করেছিল।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে বলে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের মাদ্রাসাগুলিকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য, জঙ্গি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হল— কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দেশের সমস্ত গোয়েন্দা, গুপ্তচর, ও তদন্তকারী সংস্থা রয়েছে। কোনও মাদ্রাসা বা ব্যক্তি বা সঙ্ঘ যদি দেশবিরোধী কার্যকলাপের সাথে যুক্তই থাকে তাকে গ্রেফতার না করে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করে গোটা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার সাথে জড়িত সমস্ত পড়ুয়া, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, পরিচালন সমিতি সকলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন কেন এক জন মন্ত্রী? একজন দু’জন অপরাধীর কারণে দুই-সোয়া দুই কোটি মানুষের একটি সম্প্রদায় এবং একটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সন্দেহ তালিকায় ফেলে তাঁদেরকে দেশের মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে তিনি বাংলায় রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইলেন। বুদ্ধদেব বাবুর মতোই তিনিও মাদ্রাসায় পাঠরত সমস্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ও পরিচালন ব্যাবস্থার সাথে যুক্ত সকলকে অপমান করলেন, এবং নিজের সাংবিধানিক পদকে অপমান করলেন।
মাদ্রাসা মানেই টুপি পরা, লম্বা পাঞ্জাবি পরা, পান জর্দা খাওয়া কিছু মুসলিমের আরবি উর্দু পড়ার ক্ষেত্র। আরবি হল জঙ্গিদের ভাষা! অতএব মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষক, শিক্ষার্থী সকলের কার্যকলাপ সন্দেহপূর্ণ। এটাই হল বুদ্ধদেব বাবু, জি কিশন রেড্ডি বা একশ্রেণির মানুষের মাদ্রাসা সম্পর্কে ধারণা।
মাদ্রাসা মানেই জঙ্গি তৈরির কারখানা! সত্যি যদি এমনটা হয়ে তাহলে জি কিশন রেড্ডিদেরই ব্যর্থতা। কেন তদন্ত করে তাঁরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এভাবে সন্ত্রাসবাদী সিলমোহর না দিয়ে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিন।
হতে পারে, কোন বিশেষ মাদ্রাসার, বিশেষ কোন শিক্ষক বা পড়ুয়া কোন দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত। সমাজ বিরোধী, দেশবিরোধীদের কোনও ধর্ম হয় না। যদি সেটা হয় তাহলে সরকার সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কঠোর শাস্তি দিক। মাদ্রাসায় না পড়েও কেউ সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকতে পারে। তাই বলে, নির্দিষ্ট কোন দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, সমগ্র মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ও একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষকে কাঠগড়ায় তোলা গণতন্ত্র বিরোধী এবং এক ধরণের জুলুমবাজী।
মনে রাখতে হবে, আরবি ভাষা পৃথিবীর একটি অন্যতম অর্থকরী ভাষা। ভারতবর্ষের হাজার হাজার অমুসলিম ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার গাঁটের টাকা খরচ করে আরবি ভাষা শেখেন ধনী আরব দেশগুলিতে চাকরির জন্য! এছাড়া উর্দু, আরবি ভাষা, বা ইসলামিক সংস্কৃতি বা ধর্ম তত্ব নিয়ে পড়াশোনা করা আমাদের দেশে সাংবিধানিক অধিকার (৩০ নম্বর ধারা)।
লেখিকা সুনন্দা চ্যাটার্জি