প্রতিবেদন, অয়ন বাংলা:- অমিত শাহের কথায় বিশ্বাস করে যারা নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছেন বলে মনে করছেন তারা দয়া করে এই লেখাটি পড়ুন, দেখুন অমিত শাহদের চক্রান্ত কত ভয়ংকর, কত নিষ্ঠুর —:
গত 1/10/19 তারিখ কলকাতার সভায় নাগরিকত্বের বিষয়ে অমিত শাহের কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে যে সকল হিন্দুরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছেন তারা লেখাটি পড়ুন।দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই সভায় বলেছেন — “বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের শরণার্থীর মর্যাদা দিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে”। অমিত শাহের এই কথার মধ্য দিয়ে পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের আগে শরণার্থীর স্ট্যাটাস ( মর্যাদা) দেওয়া হবে এবং তারপর নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।এবার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, তাহলে বাংলাদেশ থেকে আগত পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী হিন্দু মানুষগুলি কি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নাগরিক নয় ? অমিত শাহের কথা সত্য ধরে নিলাম যে, হিন্দুদের আগে শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হবে এবং তারপর নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তাহলে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে 2016-র NRC-র নতুন বিলে যে আইন আছে তা দেখুন। 2016 NRC বিলে আছে –“শরণার্থীদের নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর পর অন্তত ছয় বছর এদেশে বসবাস করতে হবে এবং তারপর ট্রাইবুনাল কোর্টে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে”। এবার ধরা যাক, 2020 সালে NRC বিল পাশ হলো এবং বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুরা শরণার্থীর মর্যাদা পেল (অমিত শাহের কথামতো), তাহলে ছয় বছর পর অর্থাৎ 2026 সালের পর এরা নাগরিকত্বের জন্য ট্রাইব্যুনাল কোর্টে আবেদন করবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রাইবুনাল কোর্টে কয়েক লাখ কেস পড়ে (পেন্ডিং) রয়েছে। এরপর যদি আবার দুই তিন কোটি মানুষ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে তাহলে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে আবেদন করলেই সে নাগরিকত্ব পাবে, তথাপি ট্রাইবুনাল কোর্ট থেকে নাগরিকত্ব আদায় করতে কমপক্ষে 15 বছর সময় লেগে যাবে অর্থাৎ শরণার্থী হওয়ার পর থেকে 6 + 15 = 21 বছর সময় লেগে যাবে নাগরিকত্ব পেতে। প্রায় দুই প্রজন্ম এরা বেনাগরিক হয়ে সরকারের আশ্রিত হয়ে থাকবে। আইন অনুযায়ী এদের ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে না, সরকারি চাকরির অধিকার থাকবে না, সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকার থাকবে না, সরকার দয়া করলে এদের ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ দিতে পারে– সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। অর্থাৎ এরা রাষ্ট্রের ক্রীতদাসে পরিণত হবে। রাষ্ট্র এদের যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করবে। প্রতিবাদ করার কোন জায়গা থাকবে না। গত 30/9/19 তারিখ সোমবার কলকাতা প্রেসক্লাবে দিলীপ ঘোষ একই কথা বলেন– “ছয় বছর পরে হলেও শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে”।
এখন বড় প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদের তো বর্তমানে এদেশে নাগরিকত্ব আছেই, তাহলে এদের নাগরিক থেকে টেনে নামিয়ে শরণার্থী করা হচ্ছে কেন ? এতদিন যাবৎ এদের ভোটেই MLA, MP, রাজা-মন্ত্রী হয়েছে। বর্তমান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা দেশের প্রধানমন্ত্রী এদের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছে।তাহলে এদের বেনাগরিক করা হবে কেন ? এরা অবৈধনাগরিক হলে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীও তো অবৈধ হয়ে যায়। এদের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, সরকারি চাকরি সবই আছে। তাহলে এদের কেন শরণার্থী করা হবে ? বিজেপি যদি সত্যিই হিন্দুদের ভালো চায় তাহলে এই সকল প্রমানপত্রের ভিত্তিতে কেন তাদের সরাসরি নিঃস্বর্ত নাগরিকত্ব দিচ্ছে না ? আইন অনুযায়ী এদের শরণার্থী করার সঙ্গে সঙ্গে এইসব অধিকার থেকে এরা বঞ্চিত হবে। সর্বোপরি 6 বছর পর যখন শরণার্থী থেকে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন, তখন যদি কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন হয় এবং ঐ সরকার যদি পূর্বের সরকারের আইন না মানে বা এই আইন অবৈধ বলে ঘোষণা করে, তাহলে এই সমস্ত মানুষ সারাজীবন শরণার্থী হয়েই এদেশে জীবন কাটাবেন ? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, 2016 সালের যে NRC বিল বিজেপি সরকার পাস করাতে চাইছেন, তাতে এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যেখানে শরণার্থী প্রমাণ করাটা অসম্ভব।
প্রথমতঃ আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান থেকে এসেছেন।
দ্বিতীয়তঃ আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি ওই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।
তৃতীয়তঃ আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি ওই দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে বা রাজনৈতিক কারণে অত্যাচারিত হয়ে এসেছেন। এখন বড় প্রশ্ন হলো যে, আপনি বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসেছেন এটা কিভাবে প্রমাণ দেবেন? এটা কি বাংলাদেশ সরকার আপনাকে লিখিত দেবে ?
তাছাড়া ফরেনার এ্যাক্ট, পাসপোর্ট এ্যাক্ট ইত্যাদি আরো অনেকগুলি আইন রয়েছে যেগুলোতে শরণার্থী প্রমাণ করা একেবারেই অসম্ভব। এ পর্যন্ত ভারত সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী 31,317 জন বিদেশী ভারতে রয়েছেন, যাদের সরকার দীর্ঘ মেয়াদী ভিসা দিয়েছেন এবং এদের শরণার্থী বলে উল্লেখ করেছেন। তাহলে অমিত শাহ কি শুধু এই 31,317 জনকে শরণার্থী বলে স্বীকৃতি দিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন ? কারণ অমিত শাহ 7/8/19 তারিখ লোকসভায় বসে এবং 9/9/19 তারিখ অসমে “নেডা”র চতুর্থ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বলেছেন “পশ্চিমবঙ্গে দুই কোটি ঘুসপেটিয়া ( অবৈধ অনুপ্রবেশকারী) রয়েছে, যাদের আমরা তাড়াবই”। একথা থেকে পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ থেকে যে সকল হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন তাদের সকলকেই যদি অমিত শাহ শরণার্থী ভাবতেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গে দু-কোটি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আছে, একথা কি তিনি বলতেন ? বাংলাদেশ থেকে কি 2 কোটি মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে এসেছে ? একথা বদ্ধ পাগলেও বলবে না। বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি হলে 50 থেকে 1 লাখ মুসলমান আসতে পারে, যারা মাদুর বিক্রি, মশারি বিক্রি, ছাতা সারাইয়ের কাজ করে। NRC-তে তাদের কিছুই আসবে-যাবে না। কারণ তাদের প্রত্যেকের বাংলাদেশে বাড়িঘর আছে। তাড়া মারার আগেই তারা বাংলাদেশে চলে যাবে। কিন্তু হিন্দুরা কোথায় ফিরে যাবে ? অমিত শাহ কলকাতার সভায় বলেছেন –” ভারতীয় মুসলমানদের ভয় নেই”। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে দুই কোটি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী কারা ? মাথা ঠান্ডা করে একবার ভেবে দেখুন। অর্থাৎ NRC নিয়ে অমিত শাহদের যে গভীর চক্রান্ত চলছে এবং অসমের কায়দায় বাংলার মানুষকেও যে তারা বোকা বানাচ্ছে, এ কথা একেবারে পরিষ্কার। একবার এই NRC বিল পাশ করতে পারলে আর বাঁচার কোন পথ থাকবে না। অসমে এরকম একাধিক নেতা-মন্ত্রী মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, মিষ্টি কথা বলে NRC বিল পাশ করিয়েছে, যেখানে 19 লাখ 6 হাজার 657 জনের নাম এই লিস্ট থেকে বাদ গিয়েছে, যার 16 লাখ 63 হাজার হিন্দু ও আদিবাসী এবং সেখানের হিন্দুরা এখন কেঁদেও কূল-কিনারা পাচ্ছে না। অসম থেকে বাংলার মানুষ কোনো শিক্ষা নেয়নি, তাই অমিত শাহের কথায় এরা এখনও বিশ্বাস করে আনন্দে লাফাচ্ছে। বিজেপি-RSS এর কিছু দালাল এখন আবার বলে বেড়াচ্ছে –“অসমের ব্যাপার আর বাংলার ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা।” এটা মানুষকে বোকা বানানোর বিজেপির একটা নতুন চাল বা কৌশল। যেমন বিজেপি মুসলমানদের কথা বলে আসলে হিন্দুদের সর্বনাশ করছে, এটা সরল ও নির্বোধ হিন্দুরা বুঝতে পারছে না। এখন বাঁচার একমাত্র পথ ব্যাপক গণআন্দোলনে পথে নামা। কিন্তু তার পরিবর্তে বাংলার মানুষ মেতে আছে অমিত শাহের কথাতে। তাই এদের কেউ বাঁচাতে পারবে বলে বিশ্বাস নেই। দেশ চালাচ্ছে গুজরাটি লবি। আর গুজরাটি রা চিরদিন বাঙালি বিরোধী এবং বাংলাভাষা বিরোধী। এখন তাদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা, তাই তারা ইচ্ছামত আইন পাস করিয়ে বাঙালিকে চিরদিনের জন্য জল, জমি, জঙ্গল থেকে উৎখাত করতে চাইছে, যাতে ভারতের মাটিতে বাঙালি কোনদিন উঠে দাঁড়াতে না পারে।
অমিত শাহ যে বাংলার মানুষকে ধোকা দিচ্ছে তার আরেকটি প্রমাণ হলো, গত 26/9/19 তারিখ লক্ষ্ণৌয়ের সভায় দাঁড়িয়ে যোগী আদিত্যনাথকে পাশে নিয়ে অমিত শাহ বলেন –” উত্তরপ্রদেশে এই মুহূর্তে আট লাখ বাংলাদেশী অবৈধঅনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এদের আমরা তাড়াবই”। শুধু তাই নয়, গত 1/10/19 তারিখ থেকে তাড়ানোর কাজও পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারের 28 /11/18 তারিখের রিপোর্টে বলছে যে, এই আট লাখের মধ্যে 7 লাখ 24 হাজার 378 জন হিন্দু। অর্থাৎ একথা পরিস্কার যে, অমিত শাহ উত্তরপ্রদেশ থেকে বাংলাদেশী হিন্দুদের তাড়াচ্ছে, অথচ পশ্চিমবঙ্গে এসে বলছেন অন্য কথা। এই অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদী ইত্যাদি বিজেপি-RSS দলটা এতটাই মারাত্মক যে ভোটের জন্য, রাজনীতির জন্য এরা সব কিছু করতে পারে। ঘটি পাড়ায় গিয়ে বলে বাঙালদের তাড়াবো, আবার বাঙাল পাড়ায় গিয়ে বলে মুসলমানদের তাড়াবো। এভাবে এরা দাঙ্গা তৈরি করে, মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং মানুষের রক্ত দিয়ে ভোটের বাস্ক ভরে। সরল, মূর্খ, বোকাগুলো এদের কুট কৌশল ধরতে পারেনা। বাবরি মসজিদ, পাকিস্তান, কাশ্মীর, বালাকোট আর রাম নামে এদের ভুলিয়ে রাখে। এদের নিজের ঘর পড়ুক তাতে ক্ষতি নেই, মুসলমানদের ঘর পুড়লে তাতেই আনন্দ। ফলে বাঁচার কোন পথ নেই। বাঙালির ভরাডুবি আসন্ন। শুধু বাঁচার একটাই মাত্র পথ –“NRC বিল পাস করার আগে সকলে মিলে গন আন্দোলনে পথে নামা”। তানাহলে অসমের মতো আপনাকেও ভিটে-মাটি সব হারিয়ে পথে বসতে হবে। ঘুম ভাঙ্গুন, জেগে উঠুন বাঙালী।
প্রশান্ত রায়।