বাসব রায়: অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পের নামে যে অন্যায় চলছে, তা সম্পূর্ণ মানবতাবিরোধী। ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোয় নজর দিলে প্রথমেই যা দেখা যায়, তা হল, এখানে বন্দিদের প্রায় ৯০ শতাংশই ভারতীয় নাগরিক, অথচ বিদেশি অপবাদে বছরের পর বছর অমানবিক জীবন কাটাতে হচ্ছে। গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পের সর্বমোট ২৭৩ জনের মধ্যে ৩৫ জনের ঠিকানা বাংলাদেশ, ২ জনের ঠিকানা মায়ানমার। বাকিদের ঠিকানা অসম।
উল্লেখ্য, সরকারি তথ্যে যাদের ঠিকানা বাংলাদেশ, মায়ানমার বা অন্য কোনও দেশের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা যে সেখানকার মানুষ, তার ভিত্তিও সুদৃঢ় নয়।
কোকরাঝাড় ডিটেনশন ক্যাম্পে ১৭৭ জনের মধ্যে ৩৩ জনের ঠিকানা বাংলাদেশ এবং বাকিদের ঠিকানা অসম। এদের মধ্যে ২৮টি শিশুও রয়েছে। এই ক্যাম্পেই বিজনি মহকুমার অন্তর্গত বিষ্ণুপুর গ্রামের মধুমালা মণ্ডল নামে সত্তর বছরের বৃদ্ধাকে ১০ বছর আগে প্রয়াত মধুমালা নমোদাস নামে আরেক বৃদ্ধার পরিবর্তে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। তিনবছর পর তিনি মুক্তি পান। এই ক্যাম্পেই গোয়ালপাড়া জেলার কৃষ্ণাইয়ের বাসিন্দা রেশমিনারা বেগম নামে এক গর্ভবতীকে রাখা হয়েছিল। ক্যাম্পেই তার কন্যার জন্ম হয়। পরে তিনি সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে ভারতীয় হিসেবে স্বীকৃতি পান।
শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পের ৭২ জনের মধ্যে ১৮ জনের ঠিকানা বাংলাদেশ, ৬ জনের মায়ানমার এবং বাকিদের ঠিকানা অসম। এই ক্যাম্পেই ১০২ বছরের বৃদ্ধ চন্দ্রধর দাসকে আটকে রাখা হয়েছিল।
ডিব্রুগড় ডিটেনশন ক্যাম্পে ৪৬ জন বন্দির মধ্যে ৬ জনের ঠিকানা বাংলাদেশ, বাকিদের ঠিকানা অসম।
যোরহাট ডিটেনশন ক্যাম্পে ২২০ জন বন্দির মধ্যে ৮ জনের ঠিকানা বাংলাদেশ, বাকিদের ঠিকানা অসম। এই ক্যাম্পেই মানবতাকে পদদলিত করে দু’টি দুধের শিশুকে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন করে চন্দারানি পালকে বন্দি রাখা হয়েছে।
তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে ৩৫৭ জন বন্দির মধ্যে ১৯ জনের ঠিকানা বাংলাদেশ, ১০ জনের মায়ানমার এবং বাকিদের ঠিকানা অসম। এই ক্যাম্পেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন সেনা তথা সীমান্ত শাখার পুলিশ আধিকারিককে।
এই ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি অবস্থায়ই মৃত্যু হয়েছিল দুলালচন্দ্র পালের।
কাছাড় ডিটেনশন ক্যাম্পে হাইলাকান্দির সুন্দরমণি রায় (৭৫), ভুলু সদাকর (৬৮), হাফলঙের বৃদ্ধ ইসমাইল আলি তালুকদার, কোকরাঝড় ডিটেনশন ক্যাম্পে ৭৩ বছরের বৃদ্ধা প্রভা রায়, ধুবড়ির চার মাসের শিশু নজরুল ইসলাম, যোরহাট ডিটেনশন ক্যাম্পে গোলাঘাটের ৮৮ বছরের বৃদ্ধ রশিদ আলি, গোয়ালাপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে ৬৯ বছরের বরপেটার অমৃত দাস, চিরাঙের ৮৫ বছরের বৃদ্ধ শশীমোহন সরকার, ৭০ বছরের খোকন মণ্ডল, ৩৫ বছরের যুবক দুলাল মিঞা, বরপেটার আমির আলি, ৬৫ বছরের বৃদ্ধ কামরূপের সিদ্দিক আলি, গোয়ালপাড়ার সুব্রত দে (৩৭), আবু শহিদ, গোয়ালপাড়ার পুনা মুন্ডা (৭০), নলবাড়ির ফালু দাস (৭২), গোয়ালপাড়ার নিখিল বর্মন, তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে উত্তর লখিমপুরের তাজিমুদ্দিন, নগেন দাস, ওদালগুড়ির মহম্মদ জব্বার আলি, শোণিতপুরের জাকির হুসেন, বাসুদেব বিশ্বাস (৫৯), নগাঁওয়ের সুরজ আলি (৭০), শোণিতপুরের হুসেন আলি (৪৫), আব্দুল কুদ্দুস (৬২), কবুতর বাসফর (৭৭), দুলালচন্দ্র পাল (৬৪) রাষ্ট্রযন্ত্রের শিকার।
ডিটেনশন ক্যাম্পে এখন পর্যন্ত মৃত ২৮ জনের মধ্যে একজনের মৃতদেহও বিদেশে পাঠানো হয়নি। জীবিতকালে বিদেশির তকমা নিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি এঁদের মৃত্যুর পর ভারতীয় পরিবারের হাতে তাঁদের মৃতদেহ তুলে দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে, নিহতরা সবাই ভারতীয়।
এবং মনে রাখতে হবে, সরকারি নথিতে নামের ভুল, বানানের গোলমাল, স্থায়ীভাবে ভোটার তালিকায় নাম না-থাকা, শরণার্থী সার্টিফিকেট-মাইগ্রেশন কার্ড-রিফিউজি কার্ড সরকারি নথি হিসেবে গণ্য এবং মান্য না করার ফলেই ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হয়েছে অধিকাংশ মানুষকে।
অসমে ১৯৯৭ থেকে চলছে ডি-ভোটার চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া। ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হত সন্দেহভাজন ব্যক্তি বিদেশি। কিন্তু ইলিগ্যাল মাইগ্র্যান্টস ডিটারমিনেশন ট্রাইব্যুনাল (আইএমডিটি) আইন বাতিল হওয়ার পর, ২০০৫ সালের পর থেকে, রাষ্ট্র-চিহ্নিত সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হয় তার নাগরিকত্ব।
অসমে এনআরসি-ছুট ১৯ লক্ষ। তাদের যেতে হবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। সেখানে বিদেশি ঘোষিত হলে ডিটেনশন ক্যাম্প। আর ভারত জুড়ে যে এনআরসি-র কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গলার শিরা ফুলিয়ে প্রায় রোজই বলছেন, সেখানে সন্দেহভাজনদের প্রমাণ করতে হবে যে তিনি ভারতীয় নাগরিক। ঘুরপথে সেটাই ডি-ভোটার প্রক্রিয়া। আর সন্দেহভাজনকে ভারতীয়ত্বের প্রমাণ যেখানে দিতে হবে, সেটা অবশ্যই বিদেশি ট্রাইব্যুনাল। সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হলে ডিটেনশন ক্যাম্প।
এ কোন ভারত, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক আতঙ্কে থাকবেন এই বুঝি আমার নামে সমন এল নাগরিকত্ব প্রমাণের! এ কোন দেশে আপনি আমাদের নিয়ে যেতে চাইছেন মহাপ্রতাপশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ?
সৌজন্য:-মহানগর