বাংলার প্রাণ :- এক শিক্ষণীয় উদাহরণ

Spread the love

অয়ন বাংলা ,পাঠকের কলাম ‘- দীপেন মাস্টার কে কদিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বছর পাঁচেক হলো তিনি অবসর নিয়েছেন। স্কুল আর ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবতে ভাবতে তিনি তাঁর যৌবন অতিবাহিত করে দিয়েছেন। ঘর বাঁধা আর তার হয়ে ওঠেনি। স্কুল থেকে অবসর নিলেও তাঁর বাড়িতে ছাত্র ছাত্রীদের নিত্য যাওয়া আসা লেগে আছে।এভাবেই তাঁর দিন কাটে।রোজ সকালে মধুর চায়ের দোকানে খবরের কাগজে চোখ বোলানো তাঁর চল্লিশ বছরের পুরোনো অভ্যাস।সেই মধুর বাবার আমল থেকে।বাড়িতে দুবেলা এখনো নিজের হাতে রান্না করে খান।একবেলার জন্য ও হোটেলে খাননা।আজকাল মধুর দোকানে আড্ডা টা একটু বেশি মারতেন। সন্ধ্যায় বাড়িতে ছাত্র ছাত্রীদের একটু সময় দেন।কিন্তু গত কয়েক দিন তাঁর কোনো খবর নেই।ছাত্র ছাত্রীরা ছাড়া তাঁর খবর নেওয়ার ও কেউ নেই।জানা গেছে কয়েকদিন আগে দু একটা বই কেনার জন্য তিনি কলেজ স্ট্রীটের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন।তারপর আর ফেরেননি।

দীপেনবাবু বরাবরই ট্রেনে শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে ফ্লাই ওভারের নীচ দিয়ে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে হেঁটে হেঁটে কলেজ স্ট্রীট যান।ফুটপাত থেকে বহু দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করেন।সেই নেশায় তাঁর পায়ে হাঁটা। তিনি হেঁটে চলেছেন।বয়স বেড়েছে গতি শ্লথ হয়েছে।বাম হাতে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফেলে একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলেন রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পাঁচ ছয়জন ছেলে মেয়ে একসাথে সিগারেট খাচ্ছে।মুহূর্তের মধ্যে তাঁর রুচিশীল মনটা ঠোক্কর খেলো।কোথায় যাচ্ছে বর্তমান যুবসমাজ! ছাত্র ছাত্রীরা একসাথে প্রকাশ্য রাস্তায় ধূমপান করছে !গ্রামের এই সহজ সরল আদর্শবাদী মাস্টার শহুরে রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে বলে উঠলেন- “এ তোমরা কি করছো মা ?তোমরা তো কলেজে পড়তে এসেছো।পড়াশুনা বাদ দিয়ে এ কি করছো ?তোমরা মায়ের জাত হয়ে এইভাবে ছেলেদের সাথে …ছি ছি।লোকে কি বলবে একবার ভাবলে না ?”
-“বুড়োটা জ্ঞান দিতে শুরু করলোরে।আমি আবার এসব নিতে পারি না।” বলে মুখটা বাঁকিয়ে একপাশে সরে গেলো একটা মেয়ে। অন্য একটি ছেলে হাত নাড়িয়ে বললো-“এই যে দাদু আপনার প্রবলেম টা কোথায় ?যেখানে যাচ্ছেন সোজা কেটে পড়ুন না।কেনো আমাদের মুডটা নষ্ট করছেন?”
-“সে কি বাবা !তোমাদের তো এখন জীবন গড়ে তোলার সময়। এই সময় নষ্ট করলে বাকী জীবন টা পস্তাতে হবে।আর মা জননীদের মুখে সিগারেট টা মানায় না…..।”আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।কিন্তু অপর একটি মেয়ে অতি দ্রুত তাঁর সামনে এসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো-” শুনুন আমরা খাচ্ছি আমাদের বাবার পয়সায়।তাতে আপনার কি ?আপনি মানে মানে ফুটুন তো।”বলেই দীপেন মাস্টার কে সামনের দিকে ঠেলে দিলো।মাস্টারের বহুদিনের সংস্কার হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত ঠোক্করে আঘাত পেলো।স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন-“এ তোমাদের কেমন শিক্ষা?গুরুজনদের সম্মান টুকুও দিতে পারো না ?” আগুনে যেন ঘি পড়লো।উত্তেজিত ছেলেমেয়ে গুলো রে রে করে তেড়ে এলো।-“আপনি যাবেন ?শুধু কথায় কাজ হবেনা মনে হয়। দে একটু ধুনো দিয়ে দে।” বলেই সবাই একসাথে দীপেন মাস্টারের মুখের উপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিলো। বহু সংগ্রামের সাক্ষী এই গেঁয়ো মাস্টার ও কিছুতেই দমবার পাত্র নন।তিনি ও ক্রমে উত্তেজনার পারদ চড়াতে লাগলেন।অবশেষে বিতর্ক পৌঁছে গেলো চরম পর্যায়ে ……।

আমহার্স্ট স্ট্রীট থানার পুলিশ এসে দুই পক্ষ কে থানায় নিয়ে যান। কয়েক মিনিটের মধ্যে থানায় পৌঁছে যান সবচেয়ে কম বয়সী ও বেশি সুন্দরী মেয়েটির বাবা অরূপ দত্ত। তিনি স্থানীয় কাউন্সিলরের অত্যন্ত কাছের মানুষ এবং এলাকার দাপুটে নেতা ও প্রোমোটার।…….কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেমেয়ে গুলো বাড়িতে ফিরে গেলে ও দীপেন মাস্টার আর ছাড়া পাননি।তাঁর নামে শ্লীলতাহানির কেস রুজু করা হয়। দুদিন পুলিশ কাস্টডিতে থাকার পর অবশেষে আদালতে তোলা হলো দীপেন মাস্টার কে।এতদিন তিল তিল করে তিনি যে সম্মানের ইমারত বানিয়েছিলেন তা এই দুদিনেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে।চিরদিন যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্র ছাত্রীদের আপোসহীন লড়াইয়ের কথা বলেছিলেন সেই তিনি আজ বোবা হয়ে গেছেন।তিনি তিনদিন ধরে দেখে চলেছেন কিভাবে দশ চক্রে ভগবান ও ভূত হয়ে যায়।

এজলাস কানায় কানায় পূর্ণ। এক সত্তরোর্ধ বুড়ো নাকি কলেজ ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছিল।তার বন্ধুরা কোনো রকমে তাকে রক্ষা করেছে।সেই কীর্তিমান বুড়োকে দেখতে আজ আদালত চত্বরে তিল ধারণের জায়গা নেই। মামলা শুরু হলো।সরকারি পক্ষের আইনজীবী বোঝালেন আজকের দিনে যেভাবে নারী নির্যাতন,ধর্ষণ ও খুন বেড়ে চলেছে সেখানে এইসব নারী লোলুপ শয়তান দের উপযুক্ত শাস্তি না দিলে সমাজ রসাতলে যাবে।আরো অনেক সুঁটিয়া কান্ড ,কামদুনি কান্ড ঘটবে।সরকারি আইনজীবী র জ্বালাময়ী ভাষণে সম্পূর্ণ আদালত ফেটে পড়লো।এরপর জজসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন আসামী পক্ষের আইনজীবী কে আছেন ?আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বহু কষ্টে গলায় জোর এনে দীপেন মাস্টার বললেন-“আজ্ঞে হুজুর আমার তো কেউ নেই ,কিছুই নেই।আমি শুধু দুটো কথা বলতে চাই…..”।তাঁকে থামিয়ে জজসাহেব বললেন “আপনার নাম- দীপেন্দ্র নাথ……
-“আজ্ঞে দাস।”
-” বাড়ি …….?”
-“আজ্ঞে শিবগঞ্জ, বাসন্তী। ”
-” হ্যাঁ, বলুন কি বলতে চান।”
-“হুজুর,আমি সারাজীবন শিক্ষকতা করে এলাম।ছেলে মেয়েদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিলাম।সেই আমি কন্যাসম ছাত্রীদের সাথে কি করে অশ্লীল আচরণ করবো হুজুর?আমি দুদিন ধরে থানার বাবুদের বোঝাতে পারিনি।ওরা আমার কোনো কথা শোনেননি। আপনি বিশ্বাস করুন আমি শুধু বলেছিলাম এইভাবে প্রকাশ্য রাস্তায় ছাত্রীদের সিগারেট খাওয়া উচিত নয়……..।”বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন।আবার নিজেকে সামলে নিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা টি ব্যক্ত করলেন।সমগ্র আদালত পিন পড়ার মতো নীরব।কারোর মুখে কোনো কথা নেই।সবাই যেন আয়নায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছে।নীরবতা ভাঙলেন জজসাহেব নিজেই।সরকারি আইনজীবী কে জিজ্ঞাসা করলেন-“কেসটাতো খুব সুন্দর সাজিয়েছেন।আপনার কি এখনো মনে হয় এই বৃদ্ধ মাস্টারমশাই আপনার মক্কেল মি. অরূপ দত্তের মেয়ে কে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিল ?” না , কোনো জবাব নেই।কোনো জবাব থাকতে পারে না।মিথ্যার ফানুস ফেটে পড়া টা তো শুধু সময়ের অপেক্ষা। এরপর জজসাহেব অরূপ দত্তের উদ্দেশ্যে বললেন -“সুদূর সুন্দরবনের এই বৃদ্ধ মাস্টারমশাই যে কাজটা তিনদিন আগে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে করলেন সেই কাজটা আপনি যদি আপনার বাড়িতে সময় মতো করতেন তাহলে হয়তো আজ মেয়ের জন্য আদালতে আসতে হতো না।একটু ভাবুন সামাজিক প্রতিপত্তি আভিজাত্য টা কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ”

দীপেন মাস্টার কে সসম্মানে শ্লীলতাহানির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।ধীরে ধীরে আদালত কক্ষ খালি হচ্ছে। মাস্টার ও নতমস্তকে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছেন।এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বললেন-“সাহেব আপনাকে ডাকছেন।”
-“আমাকে ?কোন সাহেব ?”বিস্মিত মাস্টার।
-“চলুন সামনের বাম দিকটার ঘরে উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।আপনি ভিতরে চলে যান।”ধীর পদক্ষেপে শঙ্কিত চিত্তে দীপেন মাস্টার ঘরে ঢুকে দেখলেন জজসাহেব তখনো পর্যন্ত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।তাঁকে দেখামাত্র জজসাহেব বললেন-“স্যার আমাকে চিনতে পারছেন ?আমি বিজন, বিজন মন্ডল।১৯৮৬তে সুন্দরবন আদর্শ বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিলাম। “বলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন।
-“কিন্তু হুজুর আমি তো ঠিক মনে করতে……..”
-“আমাকে হুজুর বলবেন না স্যার আমি আপনার ছাত্র। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি …..ছোটবেলায় একবার চক চুরি করেছিলাম বলে আপনি ডাস্টার দিয়ে আমার কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিলেন ………।”
-“ও হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে।দেখো দেখি বাবা কি অন্যায় কান্ড।সেদিন ভুল করে…….”
-“না স্যার আপনি ভুল করেননি।আপনি ভুল করতে পারেন না।সেদিন আপনি আমার কপাল ফাটিয়েছিলেন বলেই আজ আমি এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি।তা নাহলে তো আমি চোর হয়ে যেতাম স্যার।” ছাত্র গর্বে গর্বিত শিক্ষকের দুচোখ বেয়ে তখন অঝোরে নামছে অশ্রুধারা। চোখের জল ফেলে ও যে এতো আনন্দ পাওয়া যায় তা তিনি আগে কোনোদিন বোঝেননি।

খ্যাতনামা জজসাহেব শ্রীযুক্ত বিজন মন্ডল তার কৈশোরের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শ্রীযুক্ত দীপেন্দ্র নাথ দাসকে সসম্মানে শিয়ালদহ স্টেশনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। দীপেন মাস্টার আজ বাড়িতে ফিরছেন।ক্যানিং পেরিয়ে বাসন্তী হয়ে প্রবেশ করলেন শিবগঞ্জে।তাঁর অগণিত ছাত্র ছাত্রীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আর তিনি নিজে তাঁর বাকী জীবন টা আরো অনেক বিজন গড়ার কাজে সঁপে দিলেন। স্কুল থেকে অবসর নিলেও তিনি তো কর্তব্য ও আদর্শ থেকে সরে আসেননি। তাই তো অরূপ দত্ত রা আজ ও হার মেনে যায় বিজন মন্ডল দের কাছে। দীপেন মাস্টারদের দীপশিখা যুগ যুগ ধরে আলো দিয়ে যায় আঁধার ঘোঁচাতে।

* রঞ্জন ভট্টাচার্য্য *

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.