ইতিহাস
হিন্দুস্তান থেকে বাগদাদ: আরবদুনিয়ায় ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার এক বিস্মৃত অধ্যায়
লেখক :- জ্যোতির্ময় মিত্র
প্রতিবেদন :- ‘সত্য, তা যেখান থেকেই আসুক না কেন তাকে স্বীকার করতে ও গ্রহণ করতে লজ্জিত হওয়া উচিত নয়। সত্য সন্ধানীর কাছে সত্যের চেয়ে প্রিয় কিছু হওয়া উচিত নয়…।” –আলকিন্দি
কথামুখ: প্রাচীন ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চা
প্রাচীন ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার গড়ে ওঠার সময়কালেই। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের পুর্বে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মেসোপটেমিয়া সভ্যতা এবং নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতার সমসাময়িক ছিল সিন্ধু সভ্যতা। এখন প্রশ্ন হল, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার সময়ে কীভাবে বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল?
এই বিষয়ে প্রবেশ করার আগে আমরা একবার দেখার চেষ্টা করবো যে, মানব সমাজে কবে কোথায় ও কীভাবে শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানের শুভযাত্রা। এ প্রসঙ্গে জর্জ সার্টন তাঁর ‘History of Science’ গ্রন্থে এইমর্মে লিখেছেন ‘সুদুর অতীতে তার জীবনের অসংখ্য সমস্যা সমাধানে মানুষ যেদিন সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল, সেদিনই দেখা দিল বিজ্ঞানের আলো। শুরু হল তার অভিযাত্রা’। অর্থাৎ বিজ্ঞানের অবির্ভাব হয়েছিল মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই। অন্যদিকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নাল তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘Science in History তে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে সুদূর প্রাচীনকালে ‘হাতিয়ার নির্মাণ ও ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বলবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি, আগুনের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে রসায়নের ভিত্তি এবং পশুপাখি ও গাছপালা সম্বন্ধে ব্যবহারিক ও সধারনীয় ডানের মধ্যে দিয়ে জীববিজ্ঞানের ভিত্তি রচিত হয়েছিল।”
এবার সিন্ধু সভ্যতার বিষয়টিকে দেখা যাক। সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নাগরিক সভ্যতা। অর্থাৎ উন্নত পরিকল্পনাই ছিল এই প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে এই সভ্যতার প্রধানতম চালিকাশক্তি ছিল কৃষি। বিশেষত উদ্ধৃত কৃষি উৎপাদনের ফলে একটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও জন্ম দিয়েছিলেন নতুন কিছু অভিনব ভাবনা, যেমন-পোড়া মাটির ইট তৈরি, তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার, পশুশক্তিকে উৎপাদনে ব্যবহার, চাকাযুক্ত যানবাহন, যন্ত্র নির্মাণের কৌশল, লিপি ও সিলমোহর।” এমনকি মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত ‘মগন’ (বর্তমানে ওমান), ‘দিলমুন’ (বর্তমানে বাহরিন) ইত্যাদি নগরগুলির সঙ্গে নিয়মিত সামুদ্রিক বাণিজ্যের আদানপ্রদানের ফলে উৎপত্তি হয়েছিল পাটিগণিত, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো কতিপয় বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের। এ বিষয়ে অত্যন্ত প্রামাণ্য ও মূল্যবান গবেষণা হল দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘History of Science and Technology in Ancient India
The Beginnings’ নামক ধ্রুপদী গ্রন্থ। বৈদিকযুগে গণিতের স্থান ছিল অতি উচ্চে। বেদাঙ্গ জ্যোতিষের এক জায়গায় রয়েছে—
‘যথা শিখা ময়ূরাণাং নাগানাং মনয়ো যথা। তদ্বদ্বেদাসশাস্ত্রানাং গণিতং মুগ্ধণি স্থিতম॥”
(অনুবাদ: ময়ূরের মাথায় যেমন শিখা, সাপের যেমন মণি, তেমনি সমগ্র বেদাস শাস্ত্রের শীর্ষে গণিত।) প্রাচীন ভারতীয় গাণিতিকদের যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা, দশমিক ও শূন্যের ব্যবহার। “Mathematics in India’ গ্রন্থে গবেষক Kim Plofker খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অথবা দ্বিতীয় শতকে লিখিত আচার্য পিঙ্গলের ‘ছন্দঃ সূত্র’ গ্রন্থে প্রথম শূন্যের ব্যবহার খুঁজে পেয়েছেন। অন্যদিকে ইরফান হাবিবের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টিয় যুগের প্রথম দিকে ভারতবর্ষে দশমিক ও শূন্যের তাত্ত্বিক কাঠামোটি তৈরি হয়েছিল এবং গণনার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয় খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকের শেষদিকে। তবে ঐশ্লামিক দুনিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে শূন্য ও দশমিক প্রথার পরিচিতি ঘটান বিখ্যাত আরব পণ্ডিত অল-খোয়ারিজমী (আনু: ৮২৫ খ্রি:)।
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে আবির্ভূত শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অন্যতম ছিলেন আর্যভট (আনু: ৫৭৬-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ‘আর্যভট্ট’ হল বিকৃত উচ্চারণ। তাঁর শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ‘আর্যভটীয়’ ছিল সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকামাত্র। এই গ্রন্থে সর্বমোট ১২৩টি শ্লোক রয়েছে। গ্রন্থটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত, যথা—দশ গীতিকাপাদ, গণিতপাদ, কালক্রিয়াপাদ ও গোলপাদ গণিতপাদের প্রধান বিষয়বস্তু হল বর্গমূল, খনমূল, ত্রৈরাশিক ইত্যাদির আলোচনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, f (পাই)-এর নির্ভুল মান যে ৩.১৪১৬, সেটি গণিতপাদে উল্লেখ রয়েছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর মূল্যবান গবেষণা আলোচিত হয়েছে গীতিকাপাদ, কালক্রিয়াপাদে ও গোলপাদে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম পৃথিবীর আহ্নিকগতির কথা ঘোষণা করেন।” এ যুগের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার তাঁর বিখ্যাত ‘The Scientific Edge’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন-‘পাঁচশো খ্রিস্টাব্দে আর্যভট্ট অন্যান্য বিজ্ঞানীদের তুলনায় এতটাই এগিয়ে ছিলেন যে, তাঁর সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব তখনকার মানুষের বোধগম্য হয়নি। অথচ তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন যে, পৃথিবীর আকৃতি গোলকের মতো এবং তা সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে।’° অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বরাহমিহির ও ব্রহ্মগুপ্তের মতো জ্যোতির্বিদগণ পরবর্তীকালে আর্যভট প্রস্তাবিত পৃথিবীর আহ্নিকগতিতত্ত্বের বিরোধিতা করেন।” ফলে আর্যভটের অবদান বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যায়। আর্যভটের আবির্ভাবের প্রায় হাজার বছর পরে পোল্যান্ডের বিশ্ববিশ্রুত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি:) সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব পুনরায় নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহিরের রচিত দুটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ ও ‘বৃহৎসংহিতা’। প্রথম গ্রন্থে তিনি প্রাচীন ভারতের পাঁচটি প্রধান জ্যোতিষীয় গ্রন্থের (পৌলিস, রোমক, বশিষ্ঠ, সূর্য ও পৈতামহ সিদ্ধান্ত) আলোচনা করেছেন। ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে পাওয়া যায় জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল ও মণিকবিদ্যা সংক্রান্ত আগ্রহোদ্দীপক তথ্য। তবে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে, বরাহমিহির জ্যোতির্বিদ্যার পরিবর্তে জ্যোতিষবিদ্যা (ভবিষ্যৎ কথন)কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯
সপ্তম শতকে ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর ‘ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে গাণিতিক ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সমাধানের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এছাড়া ৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘খণ্ডখাদ্যক’ এর বিষয় ছিল জ্যোতির্বিদ্যা। খ্রিস্টিয় নবম শতকে দাক্ষিণাত্যের মহীশূর রাজ্যের অধিবাসী মহাবীর রচনা করেন ‘গণিত-সার-সংগ্রহ”। এই গ্রন্থে গুণোত্তর প্রগতি, ভগ্নাংশ, উপবৃত্ত, দ্বিঘাত সমীকরণের তিন প্রকার সমাধান উল্লেখ রয়েছে। আনুমানিক ৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে উজ্জয়িনীর জ্যোতির্বিদ ও গাণিতিক মুঞ্জাল ‘লঘুমানস” নামে একটি জ্যোতিষের গ্রন্থ রচনা করেন। একাদশ শতকে সমাকলীন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ শ্রীধর তাঁর ‘গণিত সার’ বা ‘ত্রিশতিকা’ গ্রন্থে শূন্যের তাৎপর্য ও ব্যবহার সংক্রান্ত চমৎকার আলোচনা করেন। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতকে ভারতীয় গণিতচর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন দ্বিতীয় ভাস্কর। ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত তাঁর ‘সিদ্ধাস্ত শিরোমণি গ্রন্থে পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যোতিষ আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় ভাস্করের (মতান্তরে ভাস্কর) আলোকসামান্য প্রতিভাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে সমরেন্দ্রনাথ সেন লিখেছেন যে, নিউটন ও লাইবনিৎজের প্রায় পাঁচশত বছর আগে ভাস্করের গাণিতিক পদ্ধতিতে ‘Integral
calculus বা সমাস গণিতের আভাস পাওয়া যায়। ১৯
এই প্রসঙ্গে ‘জ্যোতিষ’ ও ‘জ্যোতির্বিদ্যা’ শব্দদুটিকে দেখা যাক। প্রাচীন ভারতবর্ষে জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিদ্যা ছিল সমার্থক। জ্যোতিষ (দ্যু ইসিন=জ্যোতিষ শব্দের অর্থ হল ‘যে বস্তু থেকে দ্যুতি বা জ্যোতি নির্গত হয়, সেই বস্তুবিষয়ক বিদ্যা। সেই অর্থে জ্যোতিষ, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি শব্দগুলি সমার্থক এবং ইংরেজিতে যাকে Astronomy বলে তারই উপযুক্ত প্রতিশব্দ।” ফলিত জ্যোতিষের অনুপ্রবেশ ঘটে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে বরাহমিহিরের হাত ধরে। বিশেষত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’য় তিনি ফলিত জ্যোতিষকে (ভবিষ্যৎ কথন) সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কালক্রমে ভবিষ্যৎ কথকের কারবারীরা ‘জ্যোতিষ’ নামটি হস্তগত করেছিল।”
গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাশাপাশি বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও ভারতীয় মনীষার অসামান্য উজ্জ্বল স্বাক্ষর পাওয়া যায়। খ্রিস্টির প্রথম অথবা দ্বিতীয় শতকে রচিত ‘চরকসংহিতা’ এবং খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের ‘সুশ্রুত সংহিতা’ ছিল প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা বিদ্যার অপরাজেয় গ্রন্থ। এছাড়া সপ্তম শতকে বাগভট্টের রচিত ‘অষ্টাঙ্গ সংগ্ৰহ’, দ্বিতীয় বাগভট্টের ‘অষ্টাঙ্গ হৃহৃদয়-সংহিতা’ এবং একাদশ শতকে রচিত চক্রপাণিদত্তের চিকিৎসাসার সংগ্রহ ছিল চিকিৎসা বিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
বিজ্ঞানের অধোগতি:
একাদশ শতকে মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত মনীষী অল-বিরুনী (৯৭০-১০৫০ খ্রি:) ভারতীয় বিজ্ঞানীদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের (অল-বিরুনী ‘হিন্দু বিজ্ঞানী’ কথাটা ব্যবহার করেছেন) ভগবানের বরপুত্র’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। পাশাপাশি তীব্র সমালোচনাও করেছেন বিজ্ঞানচর্চার প্রতি রাজপৃষ্ঠপোষকতার অভাবের জন্য।” অবশ্য অল-বিরুনীর আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছিল। বিজ্ঞানচর্চার অবক্ষয় শুরু হয়েছিল ওই সময় থেকেই।
প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানের অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘History of Hindu Chemistry’ গ্রন্থে দ্বিবিধ যুক্তির অবতারণা করেছেন। অর্থাৎ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় দুটি কারণ আলোচনা করেছেন, যথা–সামাজিক ও মতাদর্শগত।” সামাজিক কারণ হিসাবে তিনি ভারতবর্ষের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন। আচার্য দেবের ভাষায় ‘যে-জনগণ জাতিভেদ প্রথায় নিপীড়িত ও বেদ-পুরাণ ও স্মৃতির কর্তৃত্ব ও অনুজ্ঞায় বদ্ধ ও যাদের বুদ্ধি সংকুচিত ও পক্ষাঘাত হয়ে গিয়েছে, তাদের মধ্যে কোনো বয়েল (Boyle)-এর উদয় সম্ভব নয়। ১৮
অন্যদিকে তিনি মতাদর্শগত দিক থেকে শংকরাচার্যের মায়াবাদী দর্শনকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এমনকি এ বিষয়ে প্রায় একই অভিযোগ তুলেছেন এ যুগের প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার তাঁর “The Scientific Edge: The Indian Scientists from Vedic to Modern Times নামক অনবদ্য গ্রন্থে। সুতরাং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে যে, মানুষের আর্থ-সামাজিক চাহিদার পাশাপাশি প্রাচীন ভারতবর্ষের মাটিতে বিভিন্ন বস্তুবাদী দর্শনের (চার্বাক, লোকায়ত, বৈশেযিক ইত্যাদি) উদ্ভবের ফলে বিজ্ঞানচর্চা বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু আদি মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশে একদিকে জাতিভেদ প্রথার বাড়বাড়ন্ত ও বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় এবং অন্যদিকে ভাববাদী দর্শনের প্রসার ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চাকে কলুষিত করেছিল।
এখন প্রশ্ন হল, প্রাচীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার মূল্যবান ধারাটির কি এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেছিল? ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার ঘনঘটায় ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার অভিমুখ কিছুটা ভিন্নদিকে প্রবাহিত হয়। ইতিমধ্যে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের উমাইয়া বংশীয় শাসক হজ্জাজ বিন ইউসুফের সেনাপতি মহম্মদ বিন কাশেম রাজা দাহিরকে পরাজিত ও নিহত করে সিন্ধু দেশে অধিকার করেন। প্রকৃতপক্ষে আরব অধিকৃত সিন্ধু অঞ্চলের মাধ্যমেই ভারতীয় বিজ্ঞান আরব দুনিয়ায় পৌঁছোয়। কালক্রমে আরবদের হাতধরে বিজ্ঞানচর্চা পদার্পণ করে ইউরোপের ভূমিতে।
প্রথম পর্ব:= শেষ