‘মজলিশি-আড্ডার’ কথাকার সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবন ও সাহিত্য সাধনা।
হাসিবুর রহমান
প্রতিবেদন:-; আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অসামান্য কথাকার সৈয়দ মুজতবা আলী পাঠকের আঙিনায় আজও সমান ভাবে সমাদৃত তাঁর কালজয়ী মজলিশি শৈলীতে গল্প ,ভ্রমণ সাহিত্য ,রম্য রচনা ,প্রবন্ধ সৃষ্টির জন্য। তাঁর আগমন সাহিত্যের সংসারে পালাবদলের সাড়া পড়ে গেল। নদীর বাধাহীন প্রবাহের মতো ছন্দময় ,বহুমাত্রিক , দেশি-বিদেশি অগণিত শব্দমালার প্রাচুর্য ঝরে পড়েছে তাঁর লেখনীর মধ্যে। কাজী নজরুল ইসলামের পর আরও নিপুণভাবে আরবি , ফারসি , উর্দু, জার্মান, হিব্রু, ফরাসি ভাষা- শব্দ জুড়ে বাংলা সাহিত্যে অনুপম সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন তিনি। অকাতরে এইভাবে বিশ্ব সাহিত্যের ভাষা ভান্ডার থেকে শব্দ ছিনিয়ে আনার কল্যাণে বাংলা গদ্যশলী যেন অভিনবমাত্রা পেয়েছিল সন্দেহ নেই।
আশৈশব প্রখর মেধাবী মুজতবা আলীর সাহিত্য প্রীতির পটভূমিতে জুড়ে আছে তাঁর জন্মগত পরিচয়। ১৯০৪এর ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জ এক রক্ষণশীল ,সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে তাঁর জন্ম। মা আমতুল মান্নান খাতুন,পিতা সিকন্দর আলী পেশায় সরকারি চাকুরে- সাব রেজিস্টার। ১৯২৬এ মুজতবা আলীর পিতাকে সাহিত্যচর্চার কৃতিত্ব স্বরূপ ‘নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সংঘ’ ‘ বিদ্যাভূষণ’ ও” সাহিত্য সরস্বতী” পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করে। সাহিত্যিক পিতা ও তাঁর বড় ভাই সৈয়দ মুস্তফা আলীর সৌজন্যে বাড়িতে আসতো তৎকালীন আল ইসলাহ, প্রবাসী , সাহিত্য,মানসী, কোহিনুর ইত্যাদি পত্রিকা।
ছাত্রাবস্থায় সর্বাপেক্ষা রোমাঞ্চকর ঘটনা ছিল, সপ্তম শ্রেণীতে পোড়াকালীন ‘কুইনিন’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। পরে অবশ্য কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে পাকাপাকিভাবে সাহিত্যচর্চার হাতে খড়ি হয়েছিল তাঁর।
পিতার বদলি চাকরি জীবনের কারনে করিমগঞ্জ ,সিলেট ,মৌলভীবাজার বিভিন্ন শহরের স্কুলে অতিবাহিত হয় তাঁর। জন্মভূমি সিলেট শহরকে ঘিরে ছিল তাঁর প্রশ্নতীত আবেগ ও ভালোবাসা। তিনি বহু লেখাতেই সিলেট, মৌলভীবাজারের ছায়াপট নির্মাণ করেছেন।সেই দিক থেকে বিচার করলে ঢাকা তাঁর কোন কালেই পছন্দের শহর ছিল না, বরং এপার বাংলার শান্তিনিকেতনে এসে নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলেছিলেন , আবিষ্কার করেছিলেন। আসলে ভবিষ্যৎ জীবন বোধের মানস পটভূমি নির্মাণে কবিগুরুর নিবিড় সান্নিধ্য তাঁকে পূর্ণতা দিয়েছিল। তাঁর অন্তরে কবির বিচরণ ছিল নৈকট্যের , সমগ্র জীবন জুড়ে। তিনি লিখেছেন ,” আমি নিশ্চয় করে জানি যে আমার মনো জগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া।..জানা-অজানায় গঠিত আমার চিন্তা… অনুভূতির জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।” কবির সঙ্গে তাঁর পরিচয় সিলেট শহরকে ঘিরে । প্রায় অলৌকিকভাবে কবির সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ, অতঃপর শিক্ষা লাভের জন্য শান্তিনিকেতনে গমন১৯১৯এ। শান্তিনিকেতনের ধ্রুপদী কলা, শিল্প, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল , কবির নির্মল সান্নিধ্য তাঁর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এখানে তিনি জার্মান ,ফরাসি সহ অনেক বিদেশী ভাষা সাহিত্যের শিক্ষা লাভ , নান্দনিক শিল্প চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে,তাঁর আগে কোন মুসলমান ছাত্রকে এখানে ভর্তি নেওয়ার নজির ছিল না , তিনিই প্রথম ব্যতিক্রম। অবশ্য ধর্ম জাতপাত নিয়ে কবিগুরু বিশেষ কাউকে পাত্তা দেননি। তথাপি মুজতবা লিখেছেন,” এখানে মুসলমানের সঙ্গে পরিচয় থাকাই একটা আশ্চর্য বিষয় বলে মনে হয়।” কিন্তু বাকপটু মুজতবা আলী অল্পদিনের আশ্রম জীবনে ছাত্রদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন বলে অন্নদাশঙ্কর রায় মন্তব্য করেছেন। যাইহোক বিশ্বভারতীর উন্মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা তখনও স্বীকৃতি পায়নি, তাই ১৯২৬এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রাইভেট ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএ ভর্তি হন।
মুজতবা আলীর চাকরিজীবন শুরু হয় কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে (১৯২৭-১৯২৯)।
তিনি লিখেছেন , উচ্চশিক্ষার অর্থের জন্য কাবুলে চাকরি করতে হয়েছিল তাঁকে। আফগানিস্তানের গৃহ যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে বহু কষ্টের দেশে ফেরেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য অক্সফোর্ড , কেমব্রিজকে এড়িয়ে জার্মানিতে বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয় এ কম্পারেটিভ রিলিজিয়ান বিভাগে ১৯২৯ সালে ‘হুমবল্ট’ বৃত্তি নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর আত্মজৈবনিক ভ্রমণকথা ‘ দেশে- বিদেশে’ , এবং ‘মুসাফির’এ পরিষ্কার ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের পরিচয় স্পষ্ট হয়েছে। তিনি ‘মুসাফির’এ জানিয়েছেন ,”বহু চেষ্টা করেও লন্ডনের সঙ্গে দোস্তি জমাতে পারলুম না ।পূর্বেও পারেনি…।বোধহয় ইংরেজ এদেশের রাজত্ব করেছে বলে ।বোধহয় বহুকাল ইংরেজের গোলামী করেছি বলে তার প্রতি রাগটা যেন যেতে চায় না।” তাই বিলেতের পথকে অগ্রাহ্য করে জার্মানির বনে ১৯৩০-১৯৩১সালে গবেষণা সম্পন্ন করেন।
তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল- ‘দি অরিজিন অফ দি খোজাস এন্ড দেয়ার রিলিজিয়াস লাইফ টুডে’। ১৯৩২এ বন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.ফিল ডিগ্রি প্রদান করে । উল্লেখ্য যে, মুজতবা আলী যখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তখন বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন সেখানে পড়াতেন। অতপর ১৯৩৪-৩৫ সালে মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর মুসলিম ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। দেশে ফিরে ১৯৩৫তে বরোদা কলেজে যোগদান করেন। আট বছর অধ্যাপনার পর চাকরি ছেড়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় সত্যপীর ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন। এই সময় তিনি হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড , কালান্তর ,বসুমতি ,সত্যযুগ ,মাতৃভূমি বিভিন্ন পত্রিকায় অনর্গল লিখতে থাকেন। কলকাতা শহরে আশ্রয় হয়েছিল তাঁর ছাত্র জীবনের বন্ধু রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ দার্শনিক আবু সয়ীদ আয়ুবের ৫ নং পার্ল রোডের বাড়িতে। ১৯৪৮এ সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে দেশে-বিদেশে তাঁর গল্প প্রকাশিত হতে থাকলে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। এরই মধ্যে তিনি পূর্ববঙ্গের বগুড়া আজিজুল হক কলেজে বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলনের ডাক পান বক্তৃতার জন্য। তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রাঞ্জল বক্তৃতা দিয়ে সকলকে করেন। এবং আজিজুল হক কলেজের ছাত্ররা তাঁকে
অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি তা উপেক্ষা করেননি। সৈয়দ মুজতবা আলী একটি অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের জাতীয় কবি ইকবাল ও কবি রবীন্দ্রনাথের তুলনা করে কবিগুরুর প্রশংসা করলে পাকিস্তানপন্থী ছাত্ররা তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আবার ফিরলেন কলকাতায়। এই সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে আংশিক সময়ের অধ্যাপক হিসেবেও কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে পুরনো বন্ধু হুমায়ুন কবিরের সহযোগিতায় দিল্লিতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সের বিভাগের চাকরি নেন । পরে তিনি সচিব ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর কর্মকর্তা হন। একসময় বেতারের চাকরি নিয়ে কটকে ছিলেন। কালচারাল বেতার বিভাগে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নোংরামি সহ্য করতে না পেরে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন তিনি।সবশেষে তিনি বিশ্বভারতীর ইসলামের ইতিহাস বিভাগে রীডার (১৯৬১) হিসেবে যোগদান করে সেখান থেকেই ১৯৬৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন সবশেষে তিনি।
একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও প্রবন্ধকার ,ভ্রমণ-সাহিত্য রচয়িতা তিনি।
তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি, মেজাজ, শৈলী, অগতানুগতিক। পরিশীলিত বাংলা ভাষাকে তিনি অনেক সাধনায়, অধিকারে অহংকারী সব নির্মাণ ও লিখিত রূপের বেড়াজাল ভেঙে সরলতা দান করেন। প্রথাগত শৈলীকে এড়িয়ে বিচরণ করতেন কথ্য ভাষার অলিগলিতে, মৌখিক সাহিত্যের পথেপ্রান্তরে। ফলে তাঁর লেখনীর আর্ট যেন সরস গল্পের পাঠের মতো সহজ ও সুখপাঠ্য । লেখনী,আড্ডায়, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, বক্তৃতায়, সাক্ষাৎকারে, ছিল তাঁর সেই মোহময়ী প্রতিভার ছোঁয়া। মুজতবা আলীর রচনায় রম্য ও রসের যে উপস্থিতি, তা কখনো মাত্রাতিরিক্ত নয়। কোন কথায়, কতটা কথায়, কোন প্যাঁচে কে কতটা হাসবে এবং হাসতে হাসতে ভাববে, নিজেকে মাপবে, সেই রসায়ন তিনি জানতেন , বুঝতেন। তাঁর রচিত গল্পে প্রেমের আকুতি, অনুভূতি, গভীরতা আর প্রেম পেয়ে হারানোর বেদনার যে ধ্রুপদি বর্ণনা আমরা দেখেছি ‘শবনম’–এ, তার কোনো তুলনা হয় না।
তাঁর রচনাবলীর মধ্যে : ১। দেশে বিদেশে (১৩৫৬), ২। পঞ্চতন্ত্র (১ম পর্ব–১৩৫৯, ২য় পর্ব—১৩৭৩), ৩। চাচা কাহিনি (১৩৫৯), ৪। ময়ূরকণ্ঠী (১৩৫৯), ৫। অবিশ্বাস্য (১৩৬১), ৬। পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (১৩৬৩), ৭। জলে ডাঙ্গায় (১৩৬৩), ৮। ধূপছায়া (১৩৬৪) ৯। দ্বন্দ্ব-মধুর (১৩৬৫), ১০। বড়োবাবু (১৩৭২), ১১। কত না অশ্রুজল (১৩৭২), ১২ হিটলার (১৩৭৭), ১৩ চতুরঙ্গ (১৩৬৭), ১৪। শবনম (১৩৬৭), ১৫। টুসিমেম (১৩৭০), ১৬। রাজা-উজির (১৩৭৬), ১৭। প্রেম (অনুবাদ) (১৩৭২), ১৮ দু-হাবা (১৩৭২), ১৯। হাস্য-মধুর (১৩৭৩), ২০। পছন্দসই (১৩৭৪), ২১। তুলনাহীন (১৩৮১), ২২ শহর ইয়ার (১৩৭৬), ২৩। মুসাফির (১৩৭৮), ২৪। শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৬৮), ২৫। ভবঘুরে ও অন্যান্য (১৩৬৯), ২৬। বহু বিচিত্রা (১৩৬৯), ২৭। শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা (১৩৬৯), ২৮। পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় (১৩৮২)।
বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর জন্মগত আবেগ ছিল। তিনি মনে করতেন, যে ভাষায় সংগ্রামের ইন্ধন নেই, প্রাণের প্রাচুর্য আর সুধা নেই, সেই ভাষায় কোমল-মধুর গান গাওয়া যায় কিন্তু জীবনের কথাগুলো বলিষ্ঠভাবে বলা যায় না। পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলনের বহু আগেই তিনি মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মান্যতা দেওয়ার জন্য জোর প্রশ্ন তুলে পাকিস্তান সরকারের বিরাগভাজন হন। আপোষকামিতা তাঁর স্বভাবের বৈশিষ্ট্য ছিল না , তাই বিভাগ পরবর্তী পূর্ববঙ্গের জনগণের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আবশ্যক বলে মত প্রকাশ করেন।
মুজতবার জীবনীকার নুরুল রহমান খান তাঁর সাহিত্য কর্মের মূল্যায়ন করে লিখেছেন ,
‘মুজতবা-সাহিত্যের রূপবৈচিত্র্য ও রচনাশৈলী’ গ্রন্থে বলেছেন ‘হালকা মেজাজে আড্ডার ঢঙে বলে গেলেও মুজতবা-বচন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শাস্ত্র চর্চা ও সার্থক বিচার-সমালোচনায় পরিপূর্ণ। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, বারংবার কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন হয়েছে, বহুজনের সান্নিধ্য লাভ করেছেন পণ্ডিত, গুণী, রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এবং এই সাধারণের প্রতি তার সহানুভূতি সমধিক। এর প্রতিফলন ঘটেছে মুজতবা আলীর প্রতিটি রচনায়। যে অসংখ্য ছোট ছোট রচনা তার খ্যাতির উৎস, সেগুলো ‘রম্যরচনা’ অভিধায় চিহ্নিত। কারণ, এগুলো পাঠকদের চিত্ত-বিনোদন ও অনাবিল আনন্দদানে সমর্থ সফল সৃষ্টি। বর্ণনভঙ্গির গুণে পাঠক অনেক সময় হাসির আবেগ সংবরণ করতে পারেন না বটে, কিন্তু আলী সাহেব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে বিবিধ ভাষা ও শাস্ত্র থেকে আহৃত মনীষার ফসল এই শ্রেণীর রচনার মাধ্যমে পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। তাই এগুলো নিছক রম্যরচনা নয়, সাবলীল ভাষায় প্রকাশিত মনোহর প্রবন্ধও বটে।’ তাঁর রচনার বিশেষ আকর্ষণ সরস এবং বুদ্ধিদীপ্ত এক ভাষা শৈলী । রচনায় ধরা পড়েছে অগাধজ্ঞানের অনায়াস সঞ্চরণ। খুব সহজে বৈঠকের গল্পের চালে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা মতের দর্শন পাঠকের সামনে হাজির করেন।ঠিক এরকম মেজাজ বাংলা সাহিত্যে বিরল একটি দৃষ্টান্ত। তাঁর রচিত
সাহিত্যে নির্মিত চরিত্র গুলির মানানসই সংলাপের জন্যই ভাষা সেখান জীবন্তও বৈচিত্র্যময় হয়েছে।
তাঁর মতে, যেভাষা মানুষের মুখে নিরন্তর ব্যবহৃত হয় সেই ভাষাই জীবন্ত ভাষা ,
বহুধ্বনিময় ভাষা। আলী সাহেবের গদ্য রীতিতে ভাষা শব্দের ব্যঞ্জনা , প্রকৌশল আক্ষরিক অর্থে বাক্যকে অপরূপ করে তুলেছে। তাঁর গদ্যরীতিতে ভাষার সাবেকি ভাব অনেকটা পরিশীলিত , কিন্তু প্রায় প্রতিটি সংলাপ বাক্যে জীবন্ত রূপ পেয়েছে।
তিনি ছিলেন সর্বকালের অগ্রণী সেরা বাঙালি সাহিত্যিক। অভিনব জীবন ভাবনা সৃষ্টিশীল নৈপুণ্যের বিচারে শুধু উপন্যাসিক রুপেও তাঁকে ভাবলে ভুল কিছু নয়।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সুপন্ডিত মুজতবা আলীর ধর্মবোধ ছিল সকল অর্থে সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ও জীবন-ধর্মের অনুকূলে
সৃষ্টিশীলতার মধ্যে ঈশ্বরের মহত্ত্বকে খুঁজে পেয়েছেন। মানুষকে মানুষের দৃষ্টি দিয়ে মর্যাদা দিতে হবে , এই পরিচয়ের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্ম গোষ্ঠী , সম্প্রদায়ের মধ্যে অপরিচয়ের প্রাচীর ভাঙতে হবে। কলকাতার হিন্দু সাহিত্যিকদের অনেকে সৈয়দ মুজতবাকে ব্যক্তিগতভাবে জানতেন। তাঁরা নিজেদের স্মৃতি থেকে তাঁর
জীবন ও কর্ম যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। তাঁদের লেখনীতে ফুটে উঠেছে আলী সাহেবের
স্বধর্মের বিশ্বাস বোধেরকথা। নিজের ধর্মে প্রশ্নতীত নিষ্ঠা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে মনে প্রাণে বিশুদ্ধ বাঙালিদের একজন। তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী মুসলমান হয়েও পৃথিবীর তাবৎ ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে করে গোড়ামির উর্ধ্বে উঠেছেন একথা সত্যি। বিশদে গীতা ,বেদ পাঠ কথা জানা যায়। সাহিত্যে হিন্দু মুসলমানের যৌথ সাধনা তিনি কামনা করতেন। দেশ ভাগের আগে – পরে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসের বাতাবরণে আনন্দবাজার পত্রিকায় সত্যপীর নাম নিয়ে অনর্গল লিখে গেছেন , আবেদন রেখেছেন হিন্দু মুসলমান এক হয়ে বেচেঁ থাকার।হিন্দু – মুসলমান সম্পর্কে নানা দিক নিয়ে মুজতবা সারা জীবনই ভেবেছেন । ‘ সত্যপীর’ কে দিয়ে লেখালেন ‘ ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই ‘ , ‘ ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই না ভাই ভাই এক ঠাই ’ । এবং সব শেষে ২৬ এপ্রিল ১৯৪৬ – এ ‘ ভাই ভাই এক ঠাই ‘ । হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদের দেওয়াল উঠছে । এমতাবস্থায় সত্যপীর মিলনের বার্তা শোনালেন । ‘ আচার – ব্যবহারে অশনে বসনে ’ নানা ফারাক দেখা গেলেও ধর্মের মূলতত্ত্ব সমান । সত্যপীর লিখলেন : ‘” হিন্দু – মুসলমান জনসাধারণের যুগ্ম চেষ্টায় ভারতবর্ষে গত সাতশত – আটশত বৎসর ধরিয়া যে – কৃষ্টি যে – সভ্যতা নির্মিত হইয়াছে তাহা পৃথিবীর ইতিহাসে অপূর্ব । কি ধর্মে , কি ভাষা – নির্মাণে , কি সাহিত্য – সৃষ্টিতে , কি সংগীতে কি নৃত্যে , কি বিলাস – সামগ্রী নির্মাণে , তৈজসপত্রে — কত বলিব ?”
তাঁর শেষ জীবনটা কষ্টে কেটেছে। জীবনের বেলাভূমিতে বিয়ে করে ঠিকমতো সংসারও হয়নি তাঁর। মাঝেমধ্যে দেখা হতো স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে ঢাকায় অথবা তাঁরা কলকাতায় এলে। শারীরিক অসুস্থতা , অর্থ কষ্টের জর্জরিত হয়ে নিজেকে বিপুলা পৃথিবী থেকে অনেকটা আড়াল করে রেখেছিলে। সুরাসিক্ত হয়ে পড়েন। লিখতে গেলে হাত কাঁপতো। আক্ষেপ করে বলেছিলেন , “যদি নাই লিখতে পারি বেঁচে থেকে কী হবে ?” ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে অ্যালকোহলিক পলিনিউরাইটিস রোগে আক্রান্ত হন।হয়তো জীবন প্রভাতে কোথাও একটা আঘাত পেয়েছিলেন যার সীমাহীন আশা ভঙ্গের বেদনা ছিল। সার্থকতা ও স্বপ্ন বলতে বিশেষ কিছু ছিল না তাঁর মনে । ১৯৭৪এ ঢাকায় ১১ই ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বযুগের একজন সেরা শিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলী।