বাংলার মুসলমান সমাজ : ঐতিহাসিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার

Spread the love

বাংলার মুসলমান সমাজ : ঐতিহাসিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার

দেবাশিস আইচ
———————————-
মুসলমানরা রাজনীতির ঘুঁটি। সামাজিক-রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দাবার ছকে ঘুঁটির গুরুত্ব কমে বা বাড়ে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়। মুসলমান সমাজের হাল ফেরে না। বাংলার রাজনীতিও তার ব্যতিক্রম নয়। দুর্ভাগ্য এই যে, স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও রাজ্যের এক চতুর্থাংশ মানুষ সংখ্যাগুরুর কাছে অবজ্ঞার পাত্র হয়েই রয়ে গেল। শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের জোরে, ইসলাম ও মুসলমানের সমাজ সম্পর্কে সংখ্যাগুরু বাঙালির উদাসীনতা ও অজ্ঞতা আজও অপরিসীম। আজও সংখ্যালঘু বাঙালির অপরত্ব ঘুচল না। হিন্দুর এই ‘অজ্ঞতা ঐতিহাসিক’ এবং ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের চরিত্রলক্ষণ’, এমনই তো মনে করেন সেই সব মানুষেরা, যাঁরা দশকের পর দশক ধরে ভেদ-বিভেদের দেওয়ালটির একটা একটা করে ইট সরিয়ে ফেলতে আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সামগ্রিক ভাবে সমাজে মুসলমানের অবস্থানটি ঠিক কোথায়, করে চলেছেন তার চুলচেরা বিশ্লেষণও। এই সময়ে তাঁদের সেই আলোচনা, বিশ্লেষণ যেন আরও বেশি বেশি করে জরুরি হয়ে পড়েছে। ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ কিংবা ‘মুসলিম তোষণ’-এর যে প্রায় সর্বগ্রাসী মিথ্যা চিন্তা-চেতনা, সমাজ-রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তার নিরবচ্ছিন্ন শুশ্রূষা অতি প্রয়োজন।

মুসলমান সমাজ কি কায়মনোবাক্যে এক? একটি একশিলা স্তম্ভের মতো। কোনও স্তরভেদ নেই ভাবনায়, জীবন-যাপনে, ধর্মে কিংবা অর্থনীতিতে! সত্যি সত্যি একযোগ হয়ে একটি দলকেই ভোট দেয় তারা, দিয়ে আসছে? এ প্রশ্ন সমাজতাত্ত্বিকদের বহুকালই ভাবিয়েছে। বার বার তাঁরা এর অসারত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এক রাজনৈতিক নির্মাণে, রাজনীতির প্ররোচনায় তাদের এক সমসত্ত্ব পদার্থ হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। বর্তমান বাংলায় এই ‘মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক’ রাজনীতি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। তাদের এক ও একমাত্র ‘ত্রাতা’ বা ‘মসিহা’ হয়ে ওঠার দৃষ্টিকটু প্রচেষ্টা সাধারণ ভাবে প্রায় কারোর-ই নজর এড়ায়নি। মাথায় চাদর চাপিয়ে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রমাণ করার সস্তার রাজনীতি না মুসলমানের মঙ্গল করেছে, না রাজ্যের।

দেশভাগের পর বাংলায় থেকে যায় দরিদ্র মুসলমান চাষি, কারিগর, শ্রমিকেরা। সমাজের উচ্চপ্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত, ধনবান অংশ দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। দেশভাগ কীভাবে বাঙালি হিন্দুর জীবন তছনছ করে দিয়েছে তার কথা আজও তো বলি। আর বাঙালি মুসলমানের? গল্পে-উপন্যাসে-আকাদেমিক পরিসরে খুঁজে দেখি এই দেশভাগ কীভাবে প্রভাব ফেলেছে বাংলার মুসলমানের উপর। ধুস! প্রায় সব অর্থেই সহায় সম্বলহীন মুসলমানরা গান্ধী-নেহরুর কংগ্রেসকেই আঁকড়ে ধরে। তার প্রথম ও প্রধান কারণ ছিল নিরাপত্তার বোধ বা তার অভাব। আজও এই প্রশ্নটি বার বার সবচেয়ে বেশি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের চাহিদাকে ছাপিয়ে নিরাপত্তার প্রশ্নটিই অগ্রাধিকার পেয়ে যায় প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের সময়। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা এক সময় ‘গর্ব’ করে বলত, পশ্চিমবঙ্গে বাস করতে হলে কংগ্রেসকে ভোট দিতে হবে। স্বাধীনতার বিশ বছর পার হতে না হতে এ রাজ্যে কংগ্রেস মুখীনতা কমতে শুরু করে। কমিউনিস্ট পার্টির তো দোষের অন্ত নেই, তবু, তেভাগা, নকশালবাড়ি দলিত-আদিবাসী-মুসলমান কৃষকদের মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু তাও, নিরাপত্তার অভাব বোধের প্রশ্নটি মিলিয়ে যায়নি। এ প্রসঙ্গে এটুকু অন্তত বলা যাক ‘মুসলিম প্রশ্ন’টি যে আলাদা করে ভাবার মতো, সেই কথাটি বামেরাও ভাবেনি। যেমন ভাবেনি আদিবাসী ও দলিতদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি। বোধ হয় এ কারণেই যে, ভাবনাটি ছিল শ্রেণি সংগ্রাম সব প্রশ্নের মোকাবিলা করে দেবে। যাই হোক, ২০০৬ সালের সাচার কমিটির রিপোর্ট সারা দেশে মুসলমানদের সমস্যাকে তিনটি মাত্রায় দেখার কথা বলল। তখন একটি নড়াচড়া দেখা দিল। এই তিনটি মাত্রার একটি হ’ল নিরাপত্তা। অন্য দুটি হ’ল, আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি, আর আপেক্ষিক বৈষম্য।

২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সদ্য প্রয়াত বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারকে চেয়ারম্যান করে মুসলমানদের সামাজিক, আর্থনীতিক ও শিক্ষাগত অবস্থা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করে। সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে মাথাপিছু ভোগ, দারিদ্র, সাক্ষরতার নিরিখে সারা ভারত ও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানরা পিছিয়ে। এই যে পিছিয়ে থাকাটা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ভারতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। এমনকি মুসলমানদের অবস্থান তফশিলি জাতি-জনজাতিদেরও নীচে।

মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান : পশ্চিমবঙ্গ

মাথাপিছু মাসিক ভোগ (টাকায়) : হিন্দু — ৬১০। মুসলমান — ৫০১ (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৬৩৫)। তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৫৩৪।
গ্রামে দারিদ্রের হার (শতাংশ) : হিন্দু — ২৪%। মুসলমান — ৩৬% (সর্বভারতীয় গড়ঃ ২৬.৯%)। তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৩১%।
শহরে দারিদ্রের হার (শতাংশ) : হিন্দু — ২১%। মুসলমান — ৪৪% (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৩৮.৪%)। তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৪১%।
সাক্ষরতা : হিন্দু : ৭২.৪%। মুসলমান : ৫৭.৬% (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৫৯.১%)। তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৫৬.১%।
শিশু মৃত্যুর হার : হিন্দু — ৬৮। মুসলমান — ৭৭ (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৮৩)।

মুসলমানদের এই আর্থ-সামাজিক অবস্থার জন্য রাষ্ট্রের দায় কতটুকু? অনেকেই বলেন ব্রিটিশ আমল থেকেই মুসলমানরা উদাসীনতা ও বঞ্চনার শিকার। যা আজও চলে আসছে। আবারও বলি, স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে যে মুসলমানরা রয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশ হলেন মধ্যবিত্ত নেতৃত্বহীন প্রায় নিরক্ষর, গ্রামীণ ক্ষেতমজুর, কারিগর ও কল-কারখানার শ্রমিক। মনে রাখতে হবে এ রাজ্যে মুসলমানদের ৮৩ শতাংশ গ্রামে বাস করেন। ২০০৬ সালে রাষ্ট্র্বের পরিষেবা তাদের কাছে ঠিক কতটা পৌঁছেছিল তা জানতে আমাদের সাচার কমিটির রিপোর্টে চোখ বোলাতে হবে। প্রাইমারি স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডাকঘর, বাস স্টপ, পাকা রাস্তা এই পাঁচটি প্রাথমিক সরকারি সুযোগসুবিধার পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, হিন্দু প্রধান গ্রামগুলির তুলনায় মুসলমান প্রধান গ্রামগুলি পিছিয়ে রয়েছে। রাজ্যে বিভিন্ন পরিষেবা আছে, এমন গ্রামের অনুপাত (অংশ) নীচে দেওয়া হল।

প্রাইমারি স্কুল : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৯৮.৫। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৯৭.৮।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৮১.২। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৭৩.১।
ডাকঘর : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৭৬.৪। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৫৯.৭।
বাস স্টপ আছে : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৫১.৮। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৪১.৮।
পাকা রাস্তা : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৭১.৬। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৬৪.৪।

এই পিছিয়ে থাকার কারণ যে সরকারি ঔদাসীন্য ও বৈষম্য তা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। এ কথাও এখানে স্মরণ করা জরুরি যে, সাচার কমিটির রিপোর্ট যখন প্রকাশিত হল তখন বামফ্রন্টের রাজত্বকালের বয়স ২৯ বছর। পঞ্চম পঞ্চায়েতি-রাজ চলছে। এ কথা অনস্বীকার্য, আংশিক হলেও ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েতি-রাজ, অপারেশন বর্গার ফলে তফসিলি জাতি-জনজাতি এবং মুসলমানদের এক বিপুল অংশ উপকৃত হয়েছে। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের খবর করেছি, কীভাবে এক মুসলমান গৃহবধূ পঞ্চায়েত প্রধান হওয়ার পর তাঁর গ্রামে মুখে মুখে তিন তালাক বা তালাক-ই-বিদ্দত প্রায় বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। উঠোন ঝাঁট দিয়ে, মুরগির পেট ভরিয়ে, স্বামী-সন্তানের চাহিদা মিটিয়ে কিভাবে তাঁকে পঞ্চায়েত আঁকড়ে ধরতে হয়, তা তিনি দেখিয়েছিলেন। বিস্ফারিত বিস্ময়ে তখন দেখেছি। ভেবে বিস্মিত হতে হয় এর পরও মুসলমানরা সামগ্রিক ভাবে তফসিলি জাতি-জনজাতিদের চেয়েও পিছিয়ে রইল। তবে কি এই সম্প্রদায়ের জন্য অন্য কোনও বিশেষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি ছিল?

সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে বিস্তর আলোচনা, সভা-সেমিনার, সরকারি প্রকল্পের ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু, মুসলমানরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘পোস্ট সাচার ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট’। জমা পড়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী নাজমা হেপতুল্লার কাছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিতাভ কুণ্ডুর এই রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান বা সামাজিক উন্নয়ন — প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই মুসলমানের অবস্থার উন্নতি হয়নি।” কোনও রাজ্যই সাচার কমিটির সুপারিশ কার্যকর করতে আগ্রহ দেখায়নি। এ রাজ্যও ব্যতিক্রম নয়। ততদিনে অবশ্য সাত বছর গড়িয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে এ রাজ্যেও।

ইতিমধ্যে ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ’-এর ‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অবস্থা’ শীর্ষক এক গণসমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে রাজ্যের মুসলমানদের দুরাবস্থার আদৌ কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। রিপোর্ট বলছে সমীক্ষার অন্তর্গত মুসলিম পরিবারগুলির ৩৮ শতাংশ মাসে আড়াই হাজার টাকা রোজগার করে। গ্রামের মুসলমানদের ৮০ শতাংশের রোজগার পাঁচ হাজার টাকার কম। রাজ্যের ৩২৫টি গ্রাম এবং ৭৫টি শহুরে ওয়ার্ডের ৯৭ হাজার ১৭টি মুসলমান পরিবারের ৪ লক্ষ ৬৩ হাজার ৯০৪ জনের সমীক্ষা থেকে উঠে এল, গ্রামীণ মুসলমানদের ১০.১১ শতাংশ খেতমজুর আর ৪৭.০৪ শতাংশ দিনমজুর। চাষি ১৫.৪২ শতাংশ। ১.৫৫ শতাংশ পরিবারের মূল উপার্জনকারী স্কুল শিক্ষক। সরকারি চাকরি করেন ১.৫৪ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থায় ১ শতাংশ। রাস্তা-বিদুৎ-পানীয় জল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো সরকারি পরিষেবার হালও তথৈবচ।

২০০৬ সালে দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ (সিএসডিএস) এবং লোকনীতির সমীক্ষায় দেখা গেছে মুসলমানরা দারিদ্র ও বেকারত্বকেই অধিকতর গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। আর প্রায় ষাট শতাংশ মুসলমান তাঁদের বর্তমান অবস্থার জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। অধ্যাপক কুণ্ডুর সুপারিশ ছিল, “মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য যাবতীয় উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে নিরাপত্তাবোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে। দেশজুড়ে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং হিংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটছে তা জরুরি ভিত্তিতে কঠোর হাতে দমন করা দরকার। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার উভয়কেই উদ্যোগী হয়ে সম্ভাব্য সমস্ত আইনি উপায় প্রয়োগ ক’রে তা করতে হবে।”

বামফ্রন্ট সরকার চিরকালই দাবি করে এসেছে তারা রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে। এ দাবির পিছনে সারবত্তা রয়েছে। কিন্তু, চাপড়া এবং পরবর্তীতে কাটরা মসজিদকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা, আডবানির রথযাত্রার সময় ঝালদা এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সরকারের সাফল্য বটে। ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলনও ঘটে। কিন্তু, শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের কথা বললেই তো চলে না। রুজি-রুটির বেহাল পরিস্থিতিটাকেও সামাল দিতে হয়। সমাজতাত্ত্বিকরা যেমন বলেন, “সাম্প্রদায়িক হানাহানির হাত থেকে রক্ষা পেলেও, উন্নয়নের অন্যতম সূচক শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের পশ্চাদপদতার ফলে এক দিকে সম্মানজনক কর্মে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ কম পাচ্ছেন তাঁরা। অন্য দিকে, অক্ষর ও নাগরিক সুযোগ বঞ্চিত ধর্মীয় ভাবাবেগকে সহজে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষ সাম্প্রদায়িক বৈরিতা তৈরি করছে।”

২০১১ সালে ক্ষমতায় এল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু, বিচারপতি সাচার কিংবা অধ্যাপক কুণ্ডুর সুপারিশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিপাদ্য হয়ে উঠল না। তিনি এক সহজ রাস্তা বেছে নিলেন। মুসলমানদের ‘কাছের লোক’ প্রমাণ করতে মুসলিম প্রথায় মাথায় চাদর চড়িয়ে নিলেন। সংখ্যালঘুদের চরম বেকারত্বের দিনে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ভাতার ব্যবস্থা করলেন। সংখ্যালঘু প্রধান অঞ্চলগুলিতে শিক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার চেয়ে ঘোষণা করলেন রাজ্যের ১০ হাজার খারিজি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। অথচ, মাদ্রাসা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের মতে হাজার আড়াই-তিনের বেশি খারিজি মাদ্রাসা এ রাজ্যে নেই। প্রমাণিত হল আধুনিক শিক্ষাপ্রেমী মুসলমানরা নন, মোল্লাতন্ত্র ছড়ি ঘোরানো শুরু করেছে। যে রাজ্য থেকে ৪০ বছরেরও আগে মুসলিম লিগের মতো দল উবে গিয়েছে, মুসলমানরা যেখানে কংগ্রেস, বামফ্রন্ট কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিই আস্থা দেখিয়েছে, সেখানে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের রাজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীকে দলের টিকিটে জিতিয়ে এনে মন্ত্রী করলেন। অথচ এই সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী নিজে রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে জিততে পারেননি। শুধু তাই নয়, ঢাকায় আন্তর্জাতিক আদালতে মানবতা-বিরোধী অপরাধে শাস্তি ঘোষণার পর বাংলাদেশে ব্যাপক সন্ত্রাস চালায় জামাত ও হেফাজতে-ইসলামের মতো মৌলবাদী দলগুলি। এই মৌলবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এ রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলি কলকাতায় প্রতিবাদী সমাবেশের অনুমতি পায়নি। অথচ সেই বাংলাদেশি জামাতিদের শাস্তির প্রতিবাদে এক বিশাল সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। মুসলিম নেতারা গণহত্যায় অভিযুক্ত ওই জামাত নেতাদের মুক্তির দাবি করেন। এবং এমন সভায় ধর্মীয় নেতৃত্বের পাশেই বসে থাকতে দেখা যায় তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের। এ যেন একরকম উলটো মেরুকরণের, ‘রিভার্স পোলারাইজেশন’-এর প্রচেষ্টা। মনে হয় না, বিজেপি তাঁর লক্ষ্য ছিল। তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল বামপন্থী ও কংগ্রেসিদের পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়া।

এর ফল ভালো হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নানা হিংসাত্মক ঘটনার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত মেরুকরণ চলছিলই, যার প্রভাব বাড়ছিল পশ্চিমবঙ্গেও। ২০১৭ সালে রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গোটা দেশের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের এক খতিয়ান তুলে ধরে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এ রাজ্যে যথাক্রমে ৩২টি ও ২৭টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে তা বেড়ে ৫৮ হয়। মৃত্যু হয় ৯ জনের। আহত ২৩০ জন। জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, নদিয়ার গো-রক্ষকদের তাণ্ডবের বলি হন ৬ জন। রামনবমীকে কেন্দ্র করে অভূতপূর্ব অস্ত্র মিছিল প্রত্যক্ষ করতে শুরু করল রাজ্যবাসী। দাঙ্গা ছড়াল। অন্যদিকে, শুধুমাত্র আর অনুপ্রবেশ কিংবা সীমান্তে গরু পাচারের বিরোধিতা বিজেপি কিংবা সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারের মুখ্য শ্লোগান হয়ে রইল না। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শুরু হল এক ভিন্ন সামাজিক বিক্রিয়া ঘটানোর কার্যক্রম। কখনও দলিত পরিবারে পাত পেতে খাওয়া, কখনও বা নম:শুদ্র হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে যাওয়া। আদিবাসী থেকে মধ্যজাতিদের মধ্যেও নানা কৌশলে, বিশেষ ভাবে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষোভ-বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে প্রভাব বাড়িয়ে তোলার ধারাবাহিক প্রচেষ্টাও চলছে বিগত বেশ কয়েক বছর। বিজেপি’র এই বাড়বাড়ন্তের জন্য অনেকাংশে দায়ী বামপন্থীদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দুর্বলতাও।

এই হিন্দুত্ববাদী উত্থানের বিরুদ্ধে এখনও কোনও যুতসই জবাব পাওয়া যাচ্ছে না শাসক দলের কাছ থেকে। ‘মমতাজ বেগম’ – হিন্দুত্ববাদীদের এই উপহাসের ডাক এড়াতে বিগত প্রায় দেড় বছর আর সভা-সমাবেশে চাদর চাপানো ছবিটা দেখা যাচ্ছে না। রামনবমীতে অস্ত্রধারী বিজাতীয় উল্লাস যে বাংলার সংস্কৃতি নয়, এই সার সত্য জোরের সঙ্গে বলতে পারেননি তিনি। উলটে দলকে ঠেলে দিয়েছেন রামনবমী কিংবা হনুমান পুজোর মিছিলে। ধর্মকে সামনে রেখে সংখ্যালঘু ভোট এককাট্টা করতে গিয়ে এখন কে কত বড় হিন্দু সেই প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। দাঙ্গায় জড়িত হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে স্থানীয় শাসক দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। দাপুটে নেতারা উধাও হয়ে যাচ্ছেন মানুষের চরম বিপদের সময় – এমন অভিযোগও রাশি রাশি। পুলিশ-প্রশাসনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও চোখে পড়ার মতো। বাধা দেওয়া হচ্ছে দাঙ্গা বিরোধী সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী নাগরিক উদ্যোগকে। আবার শাসক দলের তরফ থেকেও কোনও উদ্যমী উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ইমামভাতার রাজনীতির ঠেলা সামলাতে এখন জেলায় জেলায় পুরোহিত সমাবেশ ডাকতে হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে সমর্থককুল — দক্ষিণেশ্বর থেকে তারকেশ্বর — সরকারি প্রকল্পের লিস্টি কিংবা মুখ্যমন্ত্রীর দুর্গাপূজার উদ্বোধনের তালিকা আর রেড রোডে বিসর্জন কার্নিভালের নিদর্শন তুলে ধরে প্রমাণ করতে চাইছেন হিন্দুদের জন্যও কেমন প্রাণ কাঁদে সরকারের।

আর এই মেরুকরণের রাজনীতির চাপে হারিয়ে যাচ্ছে রাজ্যের এক চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষের রুজি-রোজগারের প্রশ্ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের প্রশ্ন। সম্মান ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচার প্রশ্ন। উলটে তাদের তোষণের মিথ্যা অপবাদ কুড়োতে হচ্ছে। অথচ, মুসলমান সমাজের সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে, বাধ্যতামূলক ধর্মীয় দানের টাকায় আল আমিন মিশন এবং এ জাতীয় আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নি:শব্দে সংখ্যালঘু ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার চাহিদা মিটিয়ে চলার চেষ্টা করছে। প্রায় শ’খানেক এ জাতীয় বিদ্যালয় জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সব স্কুলগুলি থেকে ফি বছর মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হচ্ছে। আরও উচ্চশিক্ষায় যাচ্ছে। ধীরে হলেও মুসলমান সমাজে উত্তরণের চিহ্নগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। অসাম্য ও বঞ্চনার জগদ্দল পাথরটাকে তারা ঠেলে সরানোর লড়াই চালাচ্ছে সম্পূর্ণ নিজস্ব চেষ্টায়। দেখতে দেখতে আল আমিন মিশনের বয়স হল প্রায় তিরিশ বছর। আবার ২০০৮-০৯ সালে ৩২৯ বছরের প্রাচীন কলকাতা মাদ্রাসাকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উন্নীত করে তৈরি হয়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলমান সমাজের ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। যদিও আলিয়া আইনত শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পা রাখলেই দেখা পাওয়া যাবে এক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীর মুখ।

সমস্যা হল আমরা প্রধানত না-বুঝে মাদ্রাসা ব্যবস্থা নিয়ে নানা কূট মন্তব্য করতে অভ্যস্ত। আল আমিন কিংবা আলিয়ার মিশন নিয়েও সমান ভাবে অজ্ঞ। এই ঐতিহাসিক অজ্ঞতাই মুসলমানকে ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ হিসাবে দেখার স্পর্ধা দেখায়। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে উৎসাহ যোগায়। প্রতিবেশীর সঙ্গে এই অপরিচয় থেকেই ক্রমে জন্মায় অজ্ঞানতা, অবিশ্বাস, অশান্তি। এ কথা তো কতবার-ই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ।

ঋণ স্বীকার : মুসলিম জাহান, মিলন দত্ত, কারিগর, ২০১৭।

লিভিং রিয়েলিটি অভ মুসলিমস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল / এ রিপোর্ট, এসোসিয়েশন স্ন্যাপ এন্ড গাইডেন্স গিল্ড, ইন এসোসিয়েশন উইথ প্রতীচী ইনস্টিটিউট, কলকাতা, ২০১৬।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেন এতটা পিছিয়ে, অভিরূপ সরকার, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ মার্চ ২০১০।

সংরক্ষণ নয়, চাই তৃণমূল স্তর থেকে মুসলিম সমাজের উন্নয়ন, অভিরূপ সরকার, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ মার্চ ২০১০।

ভোট ব্যাঙ্ক? অচিন চক্রবর্তী, এই সময়, ৭ এপ্রিল ২০১৪।

অপরিচয় গভীর, তাই অসত্যও ‘তথ্য’ হয়ে ওঠে, সাবির আহমেদ, এই সময়, ২৯ মার্চ ২০১৬।

লেখক একজন সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.