ওয়েব ডেস্ক :- এদেশে থাকতে গেলে ‘কাগজ’ দেখাতেই হবে—২০১৯ সাল থেকে এটাই ছিল বিজেপির হুঁশিয়ারি। পশ্চিমবঙ্গে স্বপ্নভঙ্গের পর সেই অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল মোদি সরকার। মঙ্গলবার সংসদে তারা সাফ জানাল, দেশজুড়ে এনআরসি হচ্ছে না। এনপিআর হলেও কাগজ দেখাতে হবে না। কেন্দ্রের হঠাৎ এই বোধোদয়ের কারণ যে নিছক একটি রাজ্য দখলের লড়াইতে পরাজয় নয়, তা স্পষ্ট। আদতে বিজেপি ও মোদি সরকারকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে জোর ধাক্কা দিয়েছে বাংলার বিপর্যয়। তাই দল ও সরকারের আগ্রাসী অ্যাজেন্ডাই বদলে দিতে হচ্ছে বলে জল্পনা তুঙ্গে।
সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআর নিয়ে সরকারের অবস্থান কী? এদিন লোকসভায় লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন তৃণমূলের এমপি সুনীল মণ্ডল। জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লিখিত আকারে জানান, ‘সিএএ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই কার্যকর হয়েছে। তবে, গোটা দেশে এনআরসি চালু করা নিয়ে সরকার এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। এনপিআর অবশ্য হবে। জনগণনার সঙ্গেই এনপিআর আপডেট হওয়ার কথা রয়েছে। কোভিডের কারণে সেই প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। এনপিআর প্রক্রিয়ায় কোনও নথিপত্র, কাগজ সংগ্রহ করা হবে না, দেখাতেও হবে না।’ অর্থাৎ, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জয়ের পর বিজেপি সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআর নিয়ে যে প্রচার শুরু করেছিল, তাতেও যতি টানার ইঙ্গিত স্পষ্ট। বিষয়টিকে সরকারের পরাজয় হিসেবেই দেখছে বিরোধীরা। সংসদের বাইরে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন তাই বলেই দেন, ‘মোদি সরকার ভয় পেয়েছে। তাই এনআরসি ও সিএএ থেকে এখন নিজেরাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’ অন্যান্য প্রচারের মতো সিএএ, এনআরসিও জুমলা কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। ডেরেকের চ্যালেঞ্জ, ‘বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পরাস্ত হয়ে বিজেপিকে এখন নিজেদের ঘোষিত অবস্থানই প্রত্যাহার করতে হবে। এটা সবে শুরু। এরকম আরও অনেক সিদ্ধান্ত থেকে মোদি সরকারকে সরে আসতে হবে।’
সারা দেশে এনআরসি করার পরিকল্পনা নেই কেন্দ্রীয় সরকারের। মঙ্গলবার সংসদে একথা জানিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই। তিনি জানিয়েছেন, নাগরিক আইন ১৯৫৫ অনুযায়ী ২০২১ সালে জনসুমারির প্রথম ধাপের সঙ্গে জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জী সংশোধন করা হবে। নাগরিকপঞ্জি নিয়ে প্রশ্নে এদিন লোকসভায় লিখিতভাবে রাই জানান, জাতীয়স্তরে এনআরসি নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।
সিএএ, এনপিআর ও এনসিআর বাতিলের দাবি করেছিল বিরোধীরা। এনআরসি নিয়ে সিদ্ধান্ত না হলেও এনপিআর হচ্ছে বলে আলাদা একটি প্রশ্নে উত্তর দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, জনগণনার সময় জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি সংশোধন করা হবে। পরিমার্জিত হবে জনবিন্যাস ও পরিবার এবং ব্যক্তির অন্যান্য তথ্য। তাতে থাকবে বায়োমেট্রিক তথ্যও। এজন্য কোনও নথি সংগ্রহ করা হবে না। কোভিড সংক্রমণের জেরে এনপিআর বন্ধ স্থগিত করা হয়েছিল। দেশের প্রতিটি নাগরিকের সামগ্রিক তথ্যপঞ্জি তৈরিই এনপিআর-র উদ্দেশ্য।
গোটা দেশে এনআরসি করা হবে বলে দাবি করে আসছিলেন অমিত শাহরা। পরে দিল্লির রামলীলা ময়দানে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, এমন কোনও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়নি। তখন প্রশ্ন ওঠে, কার কথা ঠিক? পরে শাহ জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রীই সঠিক। এনআরসি নিয়ে মন্ত্রিসভা বা সংসদে কোনও আলোচনাই হয়নি।
এখনও পর্যন্ত অসমে এনআরসি হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল চূড়ান্ত তালিকা। ৩.৩ কোটি আবেদনকারীর মধ্যে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার নাম বাদ পড়েছিল। এনিয়ে শুরু হয়েছিল তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক। এ দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, এনআরসি নিয়ে সন্তুষ্ট না হলে কোনও ব্যক্তি ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারেন। তাঁর সংযোজন, অসমে এনআরসি প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। সমস্ত রকম আইনি পথ খোলা রয়েছে। ফলে তাঁদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বিষয়টি এই পর্যায়ে বলা সম্ভব নয়।
অসমের পর বাংলায় এনআরসি চালু করাই ছিল বিজেপির শীর্ষকর্তাদের কাছে অন্যতম প্রধান অস্ত্র। বঙ্গ বিধানসভা ভোটের প্রচারে এনআরসি এবং সিএএ তাদের পক্ষে ইতিবাচক একটি ইস্যু হতে চলেছে বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। সেই কারণে শুরু হয়েছিল আগ্রাসী প্রচার। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতায় নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সরকার গঠনের পর প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই সিএএ অনুমোদিত হয়ে যাবে।’ ২০২০ সালে সিএএ কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু, সম্প্রতি দেখা গেল এখনও পর্যন্ত সিএএ সংক্রান্ত বিধিই গঠন করতে পারেনি মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কেন্দ্রের আবেদনের ভিত্তিতে নতুন করে এব্যাপারে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়সীমা বাড়িয়েছে সংসদ। কোনও আইন সংসদে পাশ এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর কার্যকর হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে তার জন্য দরকার একটি রুলস বা বিধিনিয়ম গঠন করা।
এখনও সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের রুলস নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এনআরসি সরকারি স্তরে সিদ্ধান্তই হয়নি বলে স্বয়ং মন্ত্রী জানাচ্ছেন। এমনকী, এনপিআর আপডেট করতেও কোনও কাগজ দেখাতে হবে না। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি মোদি সরকার এবং বিজেপির কাছে এই তিনটি ইস্যু রাজনৈতিকভাবে আর তাৎপর্যপূর্ণ নয়? সেগুলি কি পাঠানো হচ্ছে ঠান্ডা ঘরেই?
সৌজন্য :- বর্তমান পত্রিকা