কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি’র জমিদারি .

Spread the love

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি’র জমিদারি ….

সৌম্য চ্যাটার্জী .প্রতিবেদন :-   সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছিল এক অরাজক পরিস্থিতি। স্বজন পোষণ ও দুর্নীতিতে ডুবে গিয়েছিল শিক্ষার পরিবেশ। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হাতে পড়ে সেই অরাজকতা পৌছেছিল চরম পর্যায়ে।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতেন পুরো জমিদারী স্টাইলে। বড়বাবু, মেজবাবু, জামাইবাবু সাবেক জমিদারী নিয়মেই ডাকতে অভ্যস্ত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেরাণী, চাপরাসিরা। মেজবাবু অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, বড়বাবু অর্থাৎ উমাপ্রসাদ মুখার্জি ও জামাইবাবু অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ভগ্নিপতি প্রমথ ব্যানার্জি। বড়বাবু, মেজবাবু যদি মেনেও নেন তাই বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাইবাবু বলে ডাকছে, তাহলেই ভাবুন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন! শালা ভগ্নিপতি পরিবার অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদ-প্রমথ মুখার্জি পরিবার এবং তাদের আত্মীয় বন্ধু মিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি স্ট্রাটেজিক পয়েন্ট (ঘাঁটি) এমনভাবে আগলে বসে আছেন যে কোনও সিন্ডিকেট সভ্যের ক্ষমতা নেই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার। স্বজনপোষণের কলঙ্কমোচন দূর হওয়ার বদলে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হাত ধরে চেপে বসেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে।

কলকাতা ল কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বিখ্যাত আইনবিশারদ ডাঃ এস সি বাগচী। তিনি অবসর গ্রহণ করলে তার স্থলাভিষিক্ত হলেন জামাইবাবু প্রমথ ব্যানার্জি, এম-এ, বি-এল, বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। অথচ তার থেকে অনেক সিনিয়র ছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল কারকুন সাহেব। এছাড়া তাঁর সমসাময়িক আরও একজন অধ্যাপক ছিলেন, ডাঃ এস কে গুপ্ত এম-এ (অক্সফোর্ড), পি-এইচ-ডি (বার্ণ), বি-লিট (অক্সফোর্ড), বার-এট-ল। যদি আপনার হাতে নিয়োগের ভার থাকত তাহলে জামাইবাবুর বদলে কারকুন সাহেব অথবা ডাঃ এস কে গুপ্তকে প্রিন্সিপাল করতেন নিশ্চয়ই। কিন্তু নিজের ভগ্নিপতি বলে কথা।

শুধু তাই নয়। প্রিন্সিপালের কাজ ছিল সারা সময়ের কাজ। আগের প্রিন্সিপাল ডাঃ বাগচীও তাই করতেন। কিন্তু ভগ্নিপতির জন্য এই নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া হল অর্থাৎ তিনি আদালতে আইন ব্যবসার অনুমতি পেলেন। তাঁর কাছে ল কলেজের প্রিন্সিপালের কাজ হল যেন প্রাইভেট টিউশনি। তাই ভাইস প্রিন্সিপাল কারকুন সাহেবকে কলেজের দৈনন্দিন কাজ দেখার দায়িত্ব হল। অর্থাৎ প্রিন্সিপালের কাজটা তিনি করবেন, নাম ও সুবিধা পাবেন জামাইবাবু।

জামাইবাবুর ভাইয়ের নাম ছিল বিশ্বনাথ ব্যানার্জি ছিলেন সেকেন্ড ক্লাস এম এস সি ও লাইব্রেরির ডিপ্লোমা হোল্ডার। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ছিল এশিয়ার মধ্যে বিখ্যাত, তার লাইব্রেরিয়ান ছিলেন ডাঃ নীহার রায়, পি আর এস, পি এইচ ডি এবং লাইব্রেরিতে বিলাতী ডিপ্লোমা। জামাইবাবুর ভাই বিশ্বনাথ ব্যানার্জির জন্য ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান নামে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। পরে ডাঃ নীহার রায়কে অন্য পদে পদলী করে তার জায়গায় জামাইবাবুর ভাই বিশ্বনাথ ব্যানার্জিকে বসানো হয়। পদে নিয়োগ করার জন্য কোনও বিজ্ঞাপন দেওয়াও হয়নি। ফলে একাধিক যোগ্যতম ব্যক্তির ইচ্ছা থাকলেও আবেদন পর্যন্ত করতে পারেননি। ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান পদ থেকে জামাইবাবুর ভাই চলে যাওয়ার পর সেই শূন্য আসনে নতুন নিয়োগ করা হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল অফিস ছিল মুখার্জি ও ব্যানার্জি ভবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেকচারার, এগজামিনার, মায় পিয়ন ও দারোয়ান পর্যন্ত মুখার্জি ও ব্যানার্জি বাড়িতে গিয়ে হত্যে দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের ভিড়ে সব সময় জমজমাট থাকতো মুখার্জি ও ব্যানার্জি বাড়ি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব কলঙ্কময় ঘটনা তৎকালীন প্রশাসন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নির্দেশে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেই অপপ্রয়াস ফাঁস হয়ে যায় কমিউনিস্টদের চেষ্টায়। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি থেকে “বিশ্ববিদ্যালয় না জমিদারী” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ৪৩ পৃষ্ঠার এই পুস্তিকাটি সম্বন্ধে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় (১১ই জানুয়ারি, ১৯৪৬) প্রদত্ত বিজ্ঞাপনে বলা হয় –
“জাতির ভবিষ্যৎ ইউনিভার্সিটির হাতে
তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য ইহার কার্যকলাপ সম্পর্কে অনুসন্ধানের তাগিদ চাই/বিশ্ববিদ্যালয় না জমিদারী?

প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা তথা তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হীরেন মুখার্জি “Shyamaprasad Over Calcutta University” নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির স্বজনপোষণ তুলে ধরেন। প্রবন্ধ প্রকাশের পর বিদ্বেষ বশত হীরেন মুখার্জি ও নিখিল চক্রবর্তী কর্তৃপক্ষের বিষদৃষ্টিতে পড়েন এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট বিভাগে ‘লেকচারার’ হিসাবে ক্লাস দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তে গেছিলেন। কিন্তু সেখানে ফৌজদারি আইন বিষয়ে একবার অকৃতকার্য হয়েছিলেন। তার পরের বছর কোন রকমে তৃতীয় বিভাগে পাশ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসেন।

এই ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি …..

তথ্যসূত্রঃ
১) তরী হতে তীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
২) বাংলাভাষায় সাম্যবাদ চর্চা, প্রদীপকুমার বাগচী
৩) সোমনাথ লাহিড়ী রচনাবলী, প্রথম খণ্ড

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.